তালবিনা একটি প্রাচীন কালের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন খাবার। ইসলামে এই খাবার সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে এবং বেশি বেশি খাবার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। এই খাবারটি আমাদের মাঝে একদম নতুন হওয়ায় এর সম্পর্কে আমরা তেমন ধারণা রাখি না। তবে আমাদের এই লেখায় তালবিনা কি, কীভাবে তৈরি করে এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
তালবিনা কি?
তালবিনা আরবি শব্দ লাবান থেকে এসেছে যার বাংলা হল টকদই। সাধারণত যব বা বার্লি, দুধ ও মধু মিশিয়ে এই সুন্নতি খাবার তৈরি করা হয়। এটি দেখতে দই এর মত ঘন, সাদা ও জাউের মত দেখা যায়। সচরাচর তালবিনাকে আমরা যবের ছাতু হিসেবে চিনি তবে প্রকৃত তালবিনা যবের ছাতুর সাথে দুধ ও মধু মিশিয়ে তৈরি করা হয়। তালবিনা অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার যা বিষণ্নতা দূর করতে কাজ করে।
ইসলামিক যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ইবনে সিনা এই তালবিনাকে জ্বর ও বিষণ্নতা দূর করার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতেন। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এই খাবারকে এক অনন্য মর্যাদা দান করেছেন। মনের দুঃখকষ্ট এবং অসুস্থতা দূর করতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তালবিনা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।বুখারি শরিফের একটি হাদিসেও খাবার টি সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। রাসুল (সা:) বলেন, ‘তালবিনা’ রুগ্ন ব্যক্তির হৃদয়ে প্রশান্তি আনে এবং শোক দুঃখ কিছুটা দূর করে “ (বুখারি : ৫৪৯৭, মুসলিম : ২২১৬)
ঐতিহাসিক তাৎপর্য বাদেও তালবিনা খাওয়ার অনেক উপকার রয়েছে। বিশেষ করে যবের ছাতুতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টিগুণ। এছাড়া দুধ এবং মধুতে রয়েছে নিজস্ব পুষ্টি উপাদান। নিচে তালবিনা তৈরি করার প্রক্রিয়া ও এর উপকারিতা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
তালবিনা কিভাবে তৈরি করে?
আমরা পূর্বে জেনেছি তালবিনা অত্যন্ত উপকারী তরল খাদ্য। এতে রয়েছে নিজস্ব পুষ্টিগুণ যা একে অন্যান্য খাবার থেকে করেছে আলাদা। খুব সহজেই এবং অল্প পরিমাণ উপাদান দিয়েই তালবিনা তৈরি করা যায়। নিচে এটি তৈরি প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো।
উপকরণঃ যবের ছাতু বা গুঁড়া, দুধ, মধু ও অতিরিক্ত পুষ্টি বৃদ্ধিকারক উপাদান যেমন ঘি, কিশমিশ, বিভিন্ন বাদাম, খেজুর ইত্যাদি।
তৈরি প্রণালীঃ প্রথমে পরিমাণ মত যবের ছাতু গরম আঁচে ভেজে নিতে হবে। এরপর ভাঁজা ছাতু বা গুঁড়ায় পরিমাণ মত দুধ ঢেলে তা রান্না করে নিতে হবে। মধ্যম আঁচে কিছুক্ষণ রান্না করলে তা বাদামি রং ধারণ করবে। এই সময় তাতে স্বাদমতো মধু দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত মিশ্রণটি জাও বা ক্ষীরের মত না হয় ততক্ষণ জ্বাল দিতে হবে। এই সময় আপনি চাইলে স্বাদ ও পুষ্টি বৃদ্ধি করার জন্য ঘি, খেজুর, বাদাম, কিশমিশ ইত্যাদি দিতে পারবেন। তবে যবের ছাতুর সাথে দুধ ও মধু মেশানোর মাধ্যমেই তালবিনা তৈরি হয়ে গেছে।
তালবিনা খাওয়ার উপকারিতা
তালবিনা খাওয়ার ব্যাপক উপকারিতা রয়েছে। তাছাড়া ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই খাবারকে রোগ নিরাময়কারী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়েছে। নিচে তালবিনা খাওয়ার উপকারিতা গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
বিষণ্ণতা দূর করে
প্রাচীন কাল থেকে বিষণ্নতা ও মানুষিক অশান্তি দূর করার জন্য যবের তৈরি তালবিনা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে তালবিনা খেলে এতে থাকা পুষ্টি উপাদান শরীরে হরমোন অসামঞ্জস্যতা নিরাময় করে এবং আনন্দের হরমোন রিলিজ করে। এতে দুঃখ, হতাশা, বিষণ্নতা ইত্যাদি দূর হয় এবং প্রফুল্লতা বৃদ্ধি পায়। এটি একটি সুন্নতি খাবার যা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কেউ মারা গেলে, অসুস্থ হলে বা মানসিকভাবে কেউ অশান্তিতে থাকলে খেতে বলেছেন। কারণ এটি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার সচল রাখে যা ডিপ্রেশন দূর করে মনে প্রশান্তি আনে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
তালবিনায় প্রচুর পরিমাণ এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে যা দেহের সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া বার্লি, দুধ এবং মধুতে নিজস্ব গুণাগুন সমৃদ্ধ উপাদান থাকে যা শরীরের উপকারী এনজাইম এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল রেখে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিশেষ করে তালবিনাতে থাকা ভিটামিন, খনিজ এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার দেহের কোষ সুগঠিত করে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে।
শক্তিদায়ক
নিয়মিত তালবিনা খেলে তা শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে। কারণ এতে থাকা ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ দেহের রাসায়নিক কার্যকলাপ গতিশীল করে। এতে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং নির্জীব কোষ সচল হয়। এতে পুরো শরীরে যে যে স্থানে রোগ বাসা বেধে আঁচে তা নির্মূল হয় বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থান নেয়। তাছাড়া নিয়মিত তালবিনা খেলে তা শরীরে ক্যালরি সঞ্চয় করে যা হাড় এবং পেশির শক্তি বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ শারীরিক দুর্বলতা থাকলে নিয়মিত তালবিনা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে
পর্যাপ্ত এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় তালবিনা অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে যখন আমরা বিষণ্নতায় ভুগি তখন খাওয়ার রুচি থাকে না এবং হজম শক্তি কমে যায়। এতে কোষ্ঠকাঠিন্যতার সৃষ্টি হয় এবং শরীর তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন চেহারা তার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারায় এবং বয়সের ছাপ দেখা দেয়। কিন্তু যখন তালবিনা খাওয়া হয় তখন মনে এক ধরনের প্রফুল্লতা দেখা দেয় যা অরুচি দূর করে এবং শরীর পর্যাপ্ত ক্যালোরি পায়। ফলাফল হিসেবে অল্প বয়সে বার্ধক্যের ছাপ দূর করা সম্ভব হয়।
রক্তের উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে
তালবিনা রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে রক্ত দূষণ রোধ হয় এবং অন্যান্য উপাদানের সঠিক মাত্রা নিশ্চিত হয়। প্রকৃতিতে পাওয়া উপাদান থেকে তৈরি করা তালবিনা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ঔষধের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী।
হজম বৃদ্ধি করে
তালবিনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার থাকে। এই কারণে হজম প্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য সঠিক পদ্ধতিতে হজম হয়। যে কারণে পাচন হওয়া খাদ্য থেকে দেহ সঠিক পন্থায় প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সংগ্রহ করতে পারে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করে
তালবিনা প্রচুর পরিমাণে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার দিয়ে ভরপুর। যখন তালবিনা খাওয়া হয় তখন দ্রবণীয় ফাইবার দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে। এতে ঘন ঘন খাওয়ার প্রয়োজন পরে না যা দেহে অতিরিক্ত ক্যালোরি এবং ফ্যাট জমতে বাঁধা দেয়। এই কারণে পরোক্ষভাবে এই খাবার ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক সাহায্য করে।
হাড়ের গঠন নিয়ন্ত্রণ করে
হাড়ের গঠন ঠিক না থাকলে তা থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন রকম হাড়ের রোগ। যা আমাদের পঙ্গুত্বের মত বড় সমস্যার সম্মুখীন করে। তবে তালবিনা খাওয়ার ফলে সহজেই এই সমস্যা ঘটার পূর্বেই নিরসন করা যায়। কারণ এই খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস থাকে যা হাড়ের স্বাস্থ্য এবং গঠন উন্নত ও শক্তিশালী করে।
পেটের সমস্যা দূর করে
পেটের যে কোন ব্যথা, জ্বালাপোড়া, অম্লতা ইত্যাদি সমস্যা দূর করতে তালবিনা অনেক ভালো এবং কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কারণ এতে খাদ্য আঁশ এবং অন্যান্য উপাদান পেটের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি পিত্তথলির পাথর রোধ করে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
তালবিনায় যথেষ্ট পরিমাণ ক্রোমিয়াম থাকে যা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে ম্যাগনেসিয়াম ও দ্রবণীয় খাদ্য আঁশ রক্তের ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যে কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত করা সহজ হয়।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
তালবিনা অনেক উপকারী খাদ্য বিশেষ করে কোলন ক্যানসার রোধ করার জন্য এই খাবার বেশ উপযোগী। কারণ এতে থাকা খাদ্যআঁশ কোলনে জমা হওয়া মল পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত রাখে এবং ক্যানসার প্রতিরোধ করে।
হার্ট সুস্থ রাখে
রক্তে যদি এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে তবে তা বিভিন্ন হার্টের রোগের সৃষ্টি করে। যাইহোক, তালবিনা একটি উপকারী কোলেস্টরেলযুক্ত খাবার। অন্যদিকে বিটা-গ্লুকান ক্ষতিকর কোলেস্টেরল দূর করে এবং উচ্চ রক্তচাপ কমায় যা হার্টের সম্ভাব্য ক্ষতি নির্মূল করে।
এখানে তালবিনা কি ধরনের খাবার এবং তা খেলে আমরা কি কি উপকার পাবো সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।