আমাদের চারপাশে চোখ বোলালে দেখতে পারবো মানুষ অল্প সময়ের মধ্যেই বুড়িয়ে যাচ্ছে এবং কঠিন কঠিন রোগের শিকার হচ্ছে। এসবের প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের খাদ্যাভাস। অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদিত শস্য আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রধান কারণ হয়ে উঠছে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা এই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য অর্গানিক ফুড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করবো।
অর্গানিক ফুড কি?
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে Sir Albert Howard, F.H. King এবং Rudolf Steiner প্রমুখগণ আধুনিক বিশ্বের সাথে অর্গানিক এগ্রিকালচার শব্দটি পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের ভাষ্যমতে যে কৃষি ব্যবস্থায় কোন ধরনের কৃত্রিম কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না তাকে অর্গানিক কৃষি ব্যবস্থা বা অর্গানিক এগ্রিকালচার বলে।
অর্গানিক শব্দের অর্থ হলো জৈব এবং ফুড শব্দের অর্থ হলো খাদ্য। অর্থাৎ জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যকে অর্গানিক ফুড বলে। সহজভাবে বলতে গেলে যে কৃষি ব্যবস্থায় শস্য উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম সার এবং কীটনাশক ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তা অর্গানিক কৃষিব্যবস্থা। এই অর্গানিক কৃষিব্যবস্থা প্রয়োগ করে যে কেমিক্যাল ও হরমোন মুক্ত শস্য উৎপাদন হয় তা অর্গানিক ফুড।
পুরোপুরি পরিবেশ বান্ধব ভাবে সবুজ সার বা জৈব সার দিয়ে জমি তৈরি করে সেখানে অর্গানিক ফুড আবাদ করা হয়। সাধারণত আজকাল আমরা যে সকল শাকসবজি খেয়ে থাকি তা বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করে উৎপাদন করা হয়। রাসায়নিক এবং হরমোন পদ্ধতি ইউজ করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো কম সময়ে অধিক ফসল ফলানো। আসলে এতে আমরা নিজেরাই নিজেদের জন্য মরণ ফাঁদ তৈরি করছি।
একটা সময় ছিল যখন প্রাকৃতিক ভাবে জমি তৈরি করে সেখানে কোন সার বা কীটনাশক ব্যবহার না করে ফসল ফলানো হতো। যদিও ফসল ঘরে উঠতে বেশি সময় লাগত তবুও টাটকা এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার উৎপাদন হতো। কিন্তু বর্তমানে এই কীটনাশক ও সার দিয়ে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা নষ্ট করে কৃত্রিম উপায়ে অধিক কিন্তু অস্বাস্থ্যকর শস্য উৎপাদন হচ্ছে।
যাইহোক, অর্গানিক ফুড বর্তমান সময়ে অনেক জনপ্রিয় একটি বিষয় যার দ্বারা স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী বুঝায়। অর্গানিক ফুড উৎপাদন করতে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছা পরিষ্কারক, হরমোন ট্রিটমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় না। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সবুজ সার বা জৈব সার ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন করে বাজারজাত করা হয়।
অর্গানিক ফুড চেনার উপায়
অর্গানিক এবং নন-অর্গানিক ফুড যদি আলাদা করতে না পারেন তবে সহজেই আপনার নিয়মিত বাজারের মধ্যে ফরমালিন যুক্ত খাবার চলে আসবে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে যা দ্বারা আপনি সহজেই অর্গানিক ফুড চিনতে পারবেন।
রান্নার সময়
অর্গানিক খাবার চেনার জন্য রান্নার সময় অনেক বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আসলে ফরমালিন বা কীটনাশক যুক্ত খাবার সিদ্ধ হতে অনেক বেশি সময় লাগে। পক্ষান্তরে অর্গানিক খাবার প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত বলে দ্রুত সেদ্ধ হয়। অর্থাৎ রান্নার সময়ের উপর নির্ভর করে আপনি অর্গানিক চিহ্নিত করতে পারবেন।
আকৃতি
সার, কীটনাশক ও হরমোন ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করা হয় খাদ্য বড় এবং মোটাতাজা করার জন্য। তাই এগুলো ব্যবহার করে উৎপাদিত শস্য বা হাইব্রিড শস্য দেখতে অনেক বড় ও পরিপুষ্ট হয়। অন্যদিকে অর্গানিক শস্য দেখতে একদম স্বাভাবিক এবং পোকা মুক্ত হয়। আপনি অর্গানিক শস্য হাতে নিলেই এর বুনট টের পাবেন এবং তা যে জৈব খাবার তা বুজতে পারবেন।
স্বাদ
অর্গানিক ও নন-অর্গানিক খাবারের মধ্যে অনেক বেশি স্বাদের তারতম্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে অর্গানিক খাবারের একটি নিজস্ব গন্ধ আছে যা নাকে গেলেই উক্ত শস্যের সতেজতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আপনি অনেক কম মশলা ব্যবহার করেই অধিক স্বাদযুক্ত অর্গানিক খাবার তৈরি করতে পারবেন। পক্ষান্তরে রাসায়নিক খাবারের স্বাদ তেমন একটা থাকেনা এবং অধিক পরিমাণ মশলা ব্যবহার করে খাওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়
গন্ধ
নন-অর্গানিক ফুড থেকে অতিরিক্ত তেল এবং মশলার গন্ধ বের হয়। অন্যদিকে অর্গানিক ফুড থেকে সুন্দর ও লোভনীয় স্বাদের গন্ধ বের হয়। খাবার রান্না করার পর জৈব এবং অজৈব খাবার চিহ্নিত করা যায়।
গঠন
রং এবং গঠনের দিক দিয়ে অর্গানিক ও রাসায়নিক খাদ্য চিহ্নিত করা যায়। বিশেষকরে অজৈব খাবারের গঠন অনেক বড় ও অস্বাভাবিক হয়। অন্যদিকে অর্গানিক খাবারের রং হয় হালকা এবং দেখতে অনেক সতেজ ও আকর্ষণীয় লাগে।
অর্গানিক ফুড এর তালিকা
আমরা পূর্বে জেনেছি যে সকল খাদ্যে কোন ভেজাল, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় না সেগুলো হলো অর্গানিক ফুড। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্গানিক ফুড সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ফল
আপেল, কমলা, আঙুর, আম, কাঁঠাল, কলা সহ যাবতীয় ফল এক সময় অর্গানিক হিসেবে সব জায়গায় পাওয়া জেত। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিষাক্ত কার্বাইড ব্যবহার করে এসব ফলমূল পাকানো হয় এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান মুক্ত সকল ফলমূল অর্গানিক ফুডের তালিকাভুক্ত।
শাকসবজি
শাকসবজি আমাদের বাঙালি জাতির একটি আবেগের নাম। আমাদের প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে একবেলা কোন না কোন শাক রান্না হয়। তবে এ সকল শাকসবজি দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করা হয় যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
পেটের যত্নে প্রাকৃতিক সমাধান
– ইসবগুলের ভুসি
শস্য
যে কোন শস্য উৎপাদন করার জন্য অনেক উচ্চ মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি ও কম সময়ে শস্য উঠানোর জন্য এই ধরনের মারাত্মক অজৈব সার ব্যবহার করা হয়। আজকাল অর্গানিক শস্য উৎপাদন করার জন্য অন্যের উপর নির্ভর না করে নিজেই আবাদ করা শুরু করে দিতে হবে।
দুগ্ধজাত পণ্য
দুগ্ধজাত পণ্য আমরা দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকি। বিশেষ করে ছোট বাচ্চা এবং গর্ভবতী মায়েদের শরীরে পুষ্টিগুণ বাড়ানোর জন্য এই ধরনের পণ্য বেশি ব্যবহার হয়। তবে অসৎ ব্যবসায়ী দুধে মেলামাইন সহ আরও অনেক ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে তা বাজারজাত করে। তো অর্গানিক দুগ্ধজাত পণ্য পেতে হলে আপনাকে নিজের ডেইরী ফার্ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে অথবা বিশ্বাসযোগ্য ফার্ম থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
মাংস
গরু মোটাতাজা করার জন্য বিভিন্ন মারাত্মক ক্ষতিকর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিশেষকরে তাদের বিশেষভাবে তৈরি করা খাদ্যে ক্রোমিয়াম, ট্যানারি বর্জ্য ও অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো হয় যা অল্প সময়ে গবাদি পশু মোটা ও অধিক মাংসসম্পন্ন করে তোলে। অর্গানিক ফুড হিসেবে মাংস পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই চোখ কান খোলা রেখে খুঁজে বের করতে হবে।
অর্গানিক ফুড বনাম নরমাল ফুড
আপাতদৃষ্টিতে অর্গানিক ফুড এবং নরমাল ফুডের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। তবে এই দুটোকে আলাদা করতে চাইলে আমাদের এদের প্রভাবক নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সাধারণত নরমাল ফুড বলতে আমরা নিত্য নিমিত্ত যে যে খাবার বাজার থেকে কোন যাচাই করা ছাড়াই খাই। বিশেষ করে শহর এলাকায় অর্গানিক ফুড পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ১০% এর ও কম। কারণ গ্রামে কৃষকের থেকে পণ্য কিনে নিয়ে তা শহরে বাজারজাত করা হয়।
এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী ফরমালিন সহ অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদান মিশিয়ে তা বিক্রি করে। আমরা সচরাচর এগুলো নরমাল খাবার হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। অন্যদিকে অর্গানিক ফুড পেতে চাইলে আমাদের গ্রামে কৃষকের শরণাপন্ন হতে হবে। এটা ঠিক যে গ্রামেও ফসল আবাদ করার জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। তো আপনি যদি স্বাস্থ্য সচেতন হন তাহলে খাবার ক্রয় করার পূর্বে তার উৎপত্তিস্থল কোথায় তা বিবেচনা করে নিবেন। এতে অর্গানিক পণ্য খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।