ঘি বাঙালিদের জন্য একটি সুপার ফুড। ভোজন রসিক আমরা এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য খাবারের পুষ্টিগুণ ও স্বাদ বাড়াতে খেয়ে থাকি। তবে আমরা বেশিরভাগ মানুষ এর পুষ্টিগুণ, উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে অবগত নই। নিচে ঘি খাওয়ার নিয়ম, এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ঘি খাওয়ার নিয়ম
ঘি একটি শক্তিবর্ধক এবং উপকারী খাদ্য। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে ঘি অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে আছে। গরম ভাতের সাথে ঘি দিয়ে খেতে অনেক মজা লাগে। এই সুস্বাদু খাবার ব্যবহার করে তরকারি রান্না করলে তা অনেক সুস্বাদু হয়। ঘি যে শুধু খেতে মজা তা না, এর অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। বিভিন্ন শারীরিক প্রয়োজনে ঘি খাওয়ার নিয়মে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। আসলে নিয়ম মেনে খেলে এর দ্বারা অনেক ধরনের উপকার পাওয়া যায়। চুল পড়া সমস্যা দূর করতে ঘি অনেক ভালো কাজ করে। প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস গরম পানির সাথে এক চামচ ঘি মিশিয়ে খেলে ধীরে ধীরে চুল পড়া সমস্যার সমাধান হয়।
সামনে শীতকাল আসছে এই সময় ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ঘি এর সাথে সামান্য গোল মরিচ খাওয়া যেতে পারে। এতে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দূর হয়। ওজন কমানোর জন্য সকালে ঘি খেলে শরীরের কোলেস্টেরল বার্ন হয়ে অতিরিক্ত চর্বি জমা রোধ হয়। তাছাড়া এটি শরীরের ওজন বৃদ্ধি হওয়ার উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে ওজন কমাতে সাহায্য করে। গরম ভাপ ওঠানো ধোঁয়ার সাথে ঘি খাওয়া যায়। এক গ্লাস গরম দুধের সাথে এক চামচ ঘি মিশিয়ে খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
যে কোন তরকারি রান্না করার সময় ঘি দিলে সেই খাবারের স্বাদ অনেকগুণ বেড়ে যায়। এই কারণে বিয়ে বাড়ি বা কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে ঘি ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে সকালের বা বিকেলের নাস্তার সময় রুটি বা চাপাতির সাথে ঘি মিশিয়ে বাড়তি স্বাদ যোগ করা যায়। মোটকথা, ঘি অনেক পদ্ধতিতেই খাওয়া যায়। কি কাজে ব্যবহার করা হবে তার উপর নির্ভর করে ঘি খাওয়ার নিয়ম তৈরি করা হয়। তবে খালি পেটে, গরম দুধের সাথে এবং অন্য কোন খাবারের সাথে ঘি খাওয়া যায়।
ঘি এর পুষ্টি উপাদান
আমরা জানি ঘি তৈরি করা হয় দুধ দিয়ে। একটি খাঁটি ঘি তে দুধের মধ্যে যে যে পুষ্টি উপাদান থাকে এখানেও ঠিক তাই থাকে। এগুলোর বাইরেও ঘি এর কিছু নিজস্ব পুষ্টিগুণ আছে। নিচে এর পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ভিটামিন কে
ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধা এবং হাড় শক্ত করার কাজে লাগে। ঘিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে পাওয়া যায়।
ভিটামিন এ
ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি, প্রজনন, শারীরিক বৃদ্ধি এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজে লাগে। এছাড়া এটি শরীরের বিভিন্ন অর্গান সুস্থ রাখে। ঘি এর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ এই ভিটামিন বিদ্যমান।
ভিটামিন ডি
এই ভিটামিন দেহের ক্যালসিয়াম এবং ফসফেট নিয়ন্ত্রণ করে যা হাড়ের ক্ষয়রোধ করে। এছাড়া ভিটামিন ডি শরীরের হাড়, দাঁত এবং মাংসপেশী সুস্থ ও সবল রাখে। এই ভিটামিন ঘিতে প্রচুর পরিমাণে থাকে।
ভিটামিন ই
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সব থেকে বেশি কাজ করে ভিটামিন ই। এটি ঘি তে পরিমাণ মত থাকে।
ওমেগা থ্রি
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের কর্মক্ষমতা স্বাভাবিক রাখার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। ওজন বৃদ্ধি পাওয়া থেকে মুক্ত থাকার জন্য দেহের বেশি বেশি ওমেগা থ্রি উপাদানের প্রয়োজন পরে যা ঘিতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ঘি তে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় যে কোনো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ব্যাটাইরিক অ্যাসিড (Butyric Acid)
ঘিতে পরিমাণ মত ব্যাটাইরিক অ্যাসিড থাকে যা হজম করতে সাহায্য করে।
ব্রেন টনিক
ঘিতে ব্রেনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্রেন টনিক উপস্থিত যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
কনজুগেটেড লিনোলিক এসিড
শরীরের ওজন কমানোর জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল অ্যাসিড। ঘিতে থাকা কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে।
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিনের খাবারে রাখুন পাবনার খাঁটি গাওয়া ঘি
এছাড়া ঘিতে আছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, জিংক, আয়রন ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, চুপ পড়া রোধ করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে, হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে, মাংসপেশি ও হাড় মজবুত করে, রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। সঠিক নিয়ম পালন করে ঘি খেলে খাবারের স্বাদ যেমন বেড়ে যায় তেমনি অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ হয়।
ঘি দিয়ে রূপচর্চা
আমরা প্রায় সময় দেখে থাকি প্রকৃতি থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপাদান রূপ চর্চার কাজে ব্যবহৃত হয়। মধুর পরেই রূপ চর্চার কাজে ঘি বেশি ব্যবহার হয়। ঘি এর পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে এর দ্বারা রূপচর্চার কিছু পদ্ধতি নিচে বর্ণনা করা হলো।
- একজন মানুষের যখন ঠিকমতো হজম হয় তখন তার শরীরে সঠিক মাত্রায় পুষ্টিগুণ পৌঁছায়। যা ধীরে ধীরে তার চেহারায় পরিবর্তন আনে। মোটকথা ঘি শুধু ত্বকে ব্যবহার করেই যে রূপচর্চা করা যায় তা নয়, নিয়মমতো খেলেও উপকার হয়।
- যাদের ত্বক সবসময় শুষ্ক থাকে তারা পানির সাথে ঘি মিশিয়ে নিয়মিত ত্বকে ম্যাসেজ করলে কয়েকদিনের মধ্যেই শুষ্কভাব দূর হয়ে যাবে।
- ঠোঁটের কালো বিশ্রী দাগ দূর করার জন্য ঘি ব্যবহার করা যেতে পারে। হাতের আঙ্গুলে ঘি লাগিয়ে তা দিয়ে ঠোঁট ম্যাসেজ করে কিছু সময়ের জন্য রেখে দিতে হবে। এভাবে প্রতিদিন কিছু সময় নিয়মিত ম্যাসেজ করলে ঠোঁটের কালো দাগ দূর হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
- চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল চেহারার সৌন্দর্যের জন্য অনেক ক্ষতিকারক। কারণ এটি চেহারার আসল গুণাগুন নষ্ট করে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ঘি ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। শুধু ঘুমানোর সময় আঙুলে ঘি নিয়ে তা ডার্ক সার্কেলের উপরে লাগিয়ে নিতে হবে। পরদিন সকালে সেগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ডার্ক সার্কেল সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
- চেহারার সজীবতা ফিরিয়ে আনতে ঘি, বেসন এবং দুধ এক সাথে মিশিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করে তা ব্যবহার করা অনেক উপকারের। এতে চেহারার দুর্বলতা দূর হয়ে সজীবতা ও উজ্জ্বলতা ফিরে আসে।
- চুলের আগা ফেটে যাওয়া সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেটে ঘি অনেক ভালো কাজ করে। গোসলের আগে প্রতিদিন চুলের আগায় ঘি লাগিয়ে এক ঘণ্টা রেখে দিয়ে হবে। নিয়মিত সেবনে চুলের আগা ফাটা বন্ধ হবে এবং চুল মসৃণ হবে।
- তারুণ্য ভাব ধরে রাখার জন্য ঘি অনেক উপকারী। খাদ্যতালিকায় নিয়মিত পরিমাণমতো ঘি রাখলে তা শরীরের তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে।
ঘি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
ঘি খাওয়ার অনেক উপকারিতা এবং অপকারিতা আছে যা নিচে বর্ণনা করা হলো।
ঘি খাওয়ার উপকারিতা
- ঘি হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- এটি কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা চিরতরে দূর করে।
- ত্বকের সতেজতা বজায় রাখে।
- রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- দেহের প্রতিটি কোষের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
- মস্তিষ্কের কোষ সক্রিয় রাখে।
- জয়েন্টে ব্যথা বা আর্থাইটিস সমস্যা দূর করে।
- ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- রক্তে দূষিত কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
ঘি খাওয়ার অপকারিতা
- মাত্রা অতিরিক্ত ঘি খেলে পরিপাকতন্ত্র কাজ করা কমিয়ে দেয়। এতে হজম সমস্যা আরও প্রকোট হয়।
- ঘি তে যে পরিমাণ চর্বি থাকে তা স্বাভাবিক কিন্তু অতিরিক্ত গ্রহণে তা মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাট জনিত সমস্যার সৃষ্টি করে।
- অতিরিক্ত খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পেটে পারে।
- বেশি ঘি খেলে বদ হজম সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- দুগ্ধজাত খাবার হওয়ায় ঘি খেলে আসিডিটি ও পেট ফাঁপা বা ফুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঘি আমাদের শারীরিক দুর্বলতা দূর করার পাশাপাশি অনেক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার। উক্ত লেখায় এর উপকারিতা ও অপকারিতা সহ এর ব্যবহার বিধি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তবে আপনি যদি ভালো মানের খাটি অর্গানিক ঘি খান তবে অবশ্যই এর উপকার বয়ে আনবে। কিন্তু ভেজাল বা খারাপ কোয়ালিটির ঘি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।