সন্দেশ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের শোভা বৃদ্ধি করে। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। সন্দেশ তৈরি করার পদ্ধতি ও উপকরণের উপর ভিত্তি করে এটি অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এই লেখায় সন্দেশ কত প্রকার ও কি কি এবং বাংলাদেশের বিখ্যাত সন্দেশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
সন্দেশ কত প্রকার কি কি?
সন্দেশ বাঙালিদের দ্বারা তৈরি করা মিষ্টির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং দাওয়াতে সন্দেশ খাওয়া আমাদের অন্যতম পরিচিত ট্র্যাডিশন। তৈরি প্রণালি এবং ভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে বাহারি রকমের সন্দেশ তৈরি করা হয়। নিচে ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচিত বিভিন্ন ধরনের সন্দেশের প্রকারভেদ বর্ণনা করা হলো।
চকলেট সন্দেশ
চকলেট খেতে আমরা অনেকেই খুব পছন্দ করি। চকলেট দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার আমাদের খাদ্য তালিকায় নিয়মিত স্থান করে নেয়। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় এটি অনেক পরিচিত খাবার। যাইহোক, চকলেট ফ্লেবারকে আরও লোভনীয় ও সুস্বাদু করে তোলার জন্য চকলেট সন্দেশের পথচলা। সাধারণত গতানুগতিক সন্দেশ তৈরি করার রেসিপির সাথে কোকোয়া পাউডার ব্যবহার করে চকলেট সন্দেশ তৈরি করা হয় যা ছোট বড় সকলের নিকট অতি প্রিয়।
স্ট্রবেরি সন্দেশ
স্ট্রবেরি ফল দেখতে যেমন অনেক সুন্দর তেমনি অনেক পুষ্টিকর। এই কারণে সন্দেশ তৈরি করার জন্য এই ফল ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে স্ট্রবেরি ব্যবহার করলে সন্দেশের রং অনেক সুন্দর হয়। তবে এই সন্দেশ সচরাচর সব দোকানে পাওয়া যায় না। আপনি চাইলে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে পারবেন অথবা ঘরে তৈরি করে পরিবার নিয়ে খেতে পারবেন।
ছানার সন্দেশ
সন্দেশ বলতে মূলত আমরা ছানার সন্দেশকেই বুঝি। অল্প পরিমাণে ময়দা দিয়ে যে ছানার সন্দেশ তৈরি করা হয় তা খেতে যেমন নরম হয় তেমনি অনেক সুস্বাদু লাগে। তাছাড়া ছানার সন্দেশ আরও সুস্বাদু করার জন্য ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমের সন্দেশ
আম আমাদের দেশে সব থেকে বেশি উৎপাদিত ফলের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে আমের সিজনে আম পাওয়া যায়। এর সাথে আমের তৈরি বিভিন্ন আচারের যেমন ধুম পড়ে তেমনি এটি দিয়ে ভিন্নধর্মী রেসিপি সন্দেশ তৈরি করা যায়। বিশেষ করে খাওয়ার পর আমের সন্দেশ খেতে অনেক মজা লাগে। অন্যদিকে এটি অনেক স্বাস্থ্যকর এবং ছোট বড় সকলেই খেতে পারে।
নারকেলের সন্দেশ
নারিকেল খেতে কে না ভালোবাসে। এই ফল দিয়ে একাধারে অনেক গুলো কাজ করা যায়। তেল তৈরি করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পিঠা-পুলি ও পায়েস রান্নায় এর ব্যবহার রয়েছে। তবে নাড়ুর থেকে আলাদা সাদা রঙের নারকেল সন্দেশ না খেলে পস্তাতে হবে। এই ফলের অন্যান্য পদের সাথে সন্দেশ দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
কাঁচাগোল্লা
কাঁচাগোল্লা একটি মুখরোচক খাবার। বাংলাদেশের নাটোরের কাঁচাগোল্লা তার স্বাদ এবং অনন্য প্রস্তুত প্রণালীর জন্য জিআই পণ্যের সম্মাননা পেয়েছে। তাছাড়া এই গোল্লা বা সন্দেশ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
যাইহোক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি প্রোগ্রামে অথবা বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে এই সুস্বাদু সন্দেশ বা গোল্লা ব্যবহার করা হয়। প্রধানত সরাসরি ছানা থেকে মিষ্টির মত করে এই গোল্লা তৈরি করা হয়। কিন্তু মিষ্টি আর কাঁচাগোল্লার পার্থক্য এতে রস দেওয়া হয় না।
ক্ষীরের সন্দেশ
বাংলাদেশের নড়াইলে বিখ্যাত ক্ষীরের সন্দেশ পাওয়া যায়। সাধারণত এই সন্দেশ খেতে অনেকটা ক্ষীরের স্বাদের হয়। তবে নড়াইল বাদেও এই দেশের অনেক এলাকায় এটি পাওয়া যায়। সহজে তৈরি করা যায় বলে দোকান থেকে কিনে খাওয়ার সাথে সাথে ঘরোয়া ভাবেও ক্ষীরের সন্দেশ তৈরি করা যায়। প্রধানত দুধ থেকে ক্ষীর তৈরি করে পড়ে সেখানে চিনি গুঁড়া ও এলাচ গুঁড়া মিশিয়ে তা দিয়ে সুন্দর এই ক্ষীরের সন্দেশ তৈরি করা হয়।
কমলার সন্দেশ
কমলার সন্দেশ অথবা কমলার সুজি সন্দেশ তৈরি করা হয় কমলার খোসা অথবা দিয়ে। কমলা একটি মিষ্টি সুগন্ধ যুক্ত রসালো ফল। কমলার জুস যেমন সবাই অনেক পছন্দ করে তেমনি এটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার সবার মন কারে। যাইহোক, এই রেসিপি সচরাচর দোকানে পাওয়া না গেলেও খুব সহজে ঘরে তৈরি করা যায়।
নলেন গুড়ের সন্দেশ
নলেন গুড় থেকে তৈরি করা সন্দেশ বাংলাদেশ তথা ভারতের পশ্চিম বঙ্গের অনেক সুপরিচিত সন্দেশ। এটি খেতে যেমন অনেক সুস্বাদু তেমনি দেখতেও কালারফুল। এটি একবার খেলে বারবার খেতে মন চায়। এই ছানা সন্দেশ বাংলাদেশের অনেক জায়গায় জনপ্রিয়তার সাথে বিক্রি হয়।
প্যারা সন্দেশ
ঐতিহাসিক এই সন্দেশ শুধুমাত্র বাংলাদেশের নওগাঁয় তৈরি হয়। স্বাদ এবং গুণের ভিত্তিতে একে বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত সন্দেশ বলা হয়। সাধারণত গাভীর খাঁটি দুধ দিয়ে ক্ষীর তৈরি করে তা দিয়ে নওগাঁর প্যারা সন্দেশ তৈরি করা হয়।
ভাপা সন্দেশ
ভাপা পিঠা সম্পর্কে আমাদের সবার ধারণা থাকলেও এক মাত্র মিষ্টি প্রেমি ছাড়া ভাপা সন্দেশ সম্পর্কে আমরা তেমন ধারণা রাখি না। এই সন্দেশের সব থেকে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এটি ভাপ ব্যবহার করার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এই কারণে হাতের নাগালে উপস্থিত উপকরণ দিয়ে সহজেই ভাপা সন্দেশ তৈরি করা সম্ভব।
ফুল সন্দেশ
ফুল সন্দেশ নামকরণ করার কারণ হলো এটি বিভিন্ন ধরনের ফুল যেমন গোলাপ ও চেরি ফুল দিয়ে তৈরি। তাছার পুরো সন্দেশকে ফুলের মত খাঁজকাটা ডিজাইনের তৈরি করার কারণে অনেকটা ফুলের মতই দেখায়। সুগন্ধ যুক্ত এই সন্দেশ দেখতে এবং খেতে অনেক সুস্বাদু লাগে।
জাফরান সন্দেশ
জাফরান ব্যবহার করে যে ছানার সন্দেশ তৈরি করা হয় তাকে জাফরান সন্দেশ বলা হয়। বড় বড় অনুষ্ঠান ও বিশেষ বিশেষ অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য এই সন্দেশ সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হয়। আপনি চাইলে ঘরে বসেই এই সুন্দর ও সুস্বাদু সন্দেশ তৈরি করে পরিবার সহ উপভোগ করতে পারবেন।
পেস্তা সন্দেশ
পেস্তা সন্দেশ একটি পরিচিত মিষ্টান্ন। সাধারণত পেস্তা বাদাম দিয়ে এই সন্দেশ তৈরি করা হয় বলে এটি দেখতে সবুজ রঙের হয়। বাদাম মিশ্রণের কারণে পেস্তা সন্দেশ স্বাদে ও গুনে ভরপুর হয়ে যায়। ডায়েট পরিচালনা করে এই সন্দেশ খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
লেয়ার সন্দেশ
লেয়ার সন্দেশ বলা হয় মূলত অনেকগুলো রঙের সন্দেশ যখন একটির উপর আরেকটি বসিয়ে তৈরি করা হয়। অর্থাৎ এই ছানার সন্দেশ বিভিন্ন রঙের আলাদা আলাদা সন্দেশ দিয়ে তৈরি করা হয়। বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাবারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য এই সন্দেশ ব্যবহার করা হয়।
এলাচ সন্দেশ
প্রায় সব ধরনের সন্দেশে এলাচ ব্যবহার করা হয়। কারণ ছানার সাথে যখন এলাচ যোগ করা হয় তখন সেখান থেকে অনেক সুন্দর ঘ্রাণ আসে। এতে উক্ত খাবার আরও মুখরোচক হয়। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে তাই এলাচ সন্দেশ তৈরি করা হয়।
কোন সন্দেশ সবচেয়ে বিখ্যাত?
বাংলাদেশে প্যারা সন্দেশ ও কাঁচাগোল্লা সব থেকে বেশি বিখ্যাত। বিশেষ করে সন্দেশ হিসেবে প্যারা সন্দেশ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। প্যারা সন্দেশের ইতিহাস অনেক পুরোনো। শুরুর দিকে মহেন্দ্রী দাস নামক একজন নওগাঁ শহরের কালিতলায় সর্বপ্রথম এই সন্দেশ তৈরি করা শুরু করেন।
প্রথমদিকে বিভিন্ন মন্দিরের সামনে গিয়ে হেঁটে হেঁটে এই সন্দেশ বিক্রি করা শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি কালিতলায় দোকান দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। যা বর্তমান সময় অবধি বিভিন্ন মালিকানা পাল্টে তার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছে।
সন্দেশ বানানোর রেসিপি
ভিন্ন ধরনের সন্দেশ বানাতে আলাদা আলাদা উপকরণ প্রয়োজন পরে। তবে প্রতিটি সন্দেশ তৈরি করার জন্য কিছু কমন বিষয় অনুসরণ করতে হয় যা নিচে বর্ণনা করা হলো।
উপকরণঃ চিনি গুঁড়া বা রস, ছানা অথবা দুধের ক্ষীর, এলাচ গুঁড়া এবং সাথে স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য বাদাম, জাফরান বা অন্যান্য মশলা।
সন্দেশ প্রস্তুত প্রণালী
সন্দেশ তৈরি করার জন্য সবার প্রথমে দুধ জ্বাল দিয়ে তা থেকে ছানা তৈরি করে নিতে হবে। ছানা তৈরি হয়ে গেলে তা থেকে ভালো করে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। পানি ঝরে গেলে সেই ছানার মধ্যে চিনি এবং এলাচ গুঁড়া মিশিয়ে একটু পানি দিয়ে তা কড়াইয়ে হালকা ভেজে নিতে হবে।
তারপর কড়াই থেকে উঠিয়ে নরম ছানা সন্দেশ তৈরি করার ফর্মায় রাখতে হবে। তারপর চাপ প্রয়োগ করে কিছুক্ষণ রেখে দিলে তা সন্দেশে রূপ নেবে। এই প্রণালি প্রতিটি সন্দেশ তৈরি করার পদ্ধতির সাথে যুক্ত। আপনি চাইলে এইভাবে অথবা ক্ষীর তৈরি করে তারপর সন্দেশ বানাতে পারবেন।