সুস্বাদু রসালো আনারস ফলটি ছোট বড় প্রায় সকলের প্রিয়। গ্রীষ্মকালীন সময়ে ফলটির দেখা মেলে। গরমে শরীরের ক্লান্তি দূর করতে আনারসের জুস খেয়ে থাকি। পাকা কিংবা আধা পাকা, সুন্দর করে কেটে লোভনীয় স্বাদের আনারসের ভর্তা/মাখা খাওয়ার তৃপ্তি আলাদা।
আচার বাঙালির পছন্দের একটি মুখোরচক খাবার। আজকাল বাহিরে বিশেষ করে মেলার মধ্যে পরিচিত আচারের পাশাপাশি ব্যতিক্রম আচার দেখতে পাই। ব্যতিক্রম আচারগুলো মধ্যে আনারসের আচারটি অন্যতম। কি অবাক হচ্ছেন? আনারসের আচারের কথা শুনে ভাবছেন হয়তো, আনারসের আচার হয় নাকি আবার! জি, আনারস তো অনেক খেয়েছেন, চলুন তাহলে আজকে আমরা আনারসের আচার সম্পর্কে আলোচনা করবো।
আনারসের আচার
আমরা ছোটবেলা থেকেই আম, বড়ই, জলপাই ইত্যাদি মায়ের হাতের আচার খেয়ে বড় হয়েছি। খুব কম সংখ্যক মানুষ আনারসের আচারটির সাথে পরিচিত। ফলটি যেমন রসালো ও মজাদার, তেমনি এই আচারটি খেতেও মুখোরচক হয়ে থাকে। আচার তৈরের সহজ রেসিপি শেয়ার করা হলো, রেসিপিটি ফলো করে খুব সহজেই ঘরোয়াভাবে তৈরি করতে পারবেন।
আনারসের কাশ্মেরী আচার
কোনো রকম রোদে দেওয়ার ঝামেলা ছাড়াই আচারটি তৈরি করা যায় এবং আচার তৈরি করে রোদেও দিতে হয়না। এটি খেতে খুবই সুস্বাদু, তৈরিও করা যায় খুব কম সময়ে। চলুন দেখে নেই, এই আচার কিভাবে তৈরি করতে হয়।
উপকরণ
- আনারস ১টি বড় সাইজের
- চিনি ১ কাপ
- পানি হাফ কাপ
- লবন স্বাদমতো
- ভিনেগার/ সাদা সিরকা
- আদা কুচি ১চা চামচ
- শুকনো মরিচ কুচি( বীজ ছাড়িয়ে) ৩/৪টি
প্রথমে একটি প্যানে চিনি ও পানি দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। চিনি গলে গেলে এরমধ্যে কুচি করে রাখা আদা ও লবন দিয়ে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে মিশিয়ে নিতে হবে। আদা গলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আদা গলে গেলে এবং আদার ঘ্রাণ বের হলে কিউব করে কেটে রাখা আনারস দিতে হবে। কিছুক্ষণ পরে শুকনো মরিচ কুচি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। সিরা ঘন হয়ে এলে চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে।
টিপস
আনারসের কাশ্মেরী আচারটি গরম অবস্থায় খাওয়া যাবেনা। পুরোপুরি ঠান্ডা করে খেতে হবে।
আচার তৈরিতে শুকনো মরিচটি রান্নার শেষের দিকে দিতে হবে। প্রথমেই দিলে অনেক ঝাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু রোদের দেওয়ার কোনো ঝামেলা নেই। তাই আচারটি একটি কাচের বোয়ামে সংরক্ষণ করে সাধারণ তাপমাত্রায় অথবা ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করা যাবে।
টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের আনারসের আচার
আনারসের এই টক মিষ্টি ঝালের আচারটি খেতে বেশ মজাদার। সহজ করে এই রেসিপি তুলে ধরা হলো।
উপকরণ
- আনারস ২টি (মাঝারি সাইজের)
- চিনি ১ কাপ
- লেবুর রস ৪ টেবিল চামচ
- পাঁচফোড়ন ১টেবিল চামচ
- কালোজিরা হাফ চা চামচ
- মেথি হাফ চা চামচ
- সরিষা হাফ চা চামচ
- তেজপাতা ১টি
- আস্ত শুকনো লাল মরিচ ২/৩টি
- চিনি ফ্লেক্স ১ টেবিল চামচ
- বিট লবন হাফ চা চামচ
- লবন স্বাদ অনুযায়ী
যেভাবে তৈরি করবেন
প্রথমে পাঁচফোড়ন একটু গরম করে নিতে হবে। তারপরে চুলায় একটি প্যানে সরিষার তেল দিয়ে কালোজিরা, মেথি, তেজপাতা, শুকনো লাল মরিচ দিয়ে একটু ভেজে নিতে হবে। ঘ্রাণ বের হলে পছন্দ অনুযায়ী কিউব করে কাটা আনারস মিশিয়ে নিতে হবে। চুলার আচঁ কমিয়ে আনারস সিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত নেড়ে নিতে হবে। পানি শুকিয়ে গেলে চিনি দিয়ে নেড়েচেড়ে মিক্সড করে নিতে হবে।
এর পরে চিনির সিরা ঘন হয়ে ও আনারসের রং পরিবর্তেন হলে বিট লবন ও খাওয়ার লবন দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপরে পরিমাণমত চিলি ফ্লেক্স ও লেবুর রস দিতে হবে। আরও কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়ার পরে গরম করে নেওয়া পাঁচফোড়ন দিয়ে আচারের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপরে চুলা থকে নামিয়ে অন্য একটি পাত্রে তুলে নিতে হবে।
আনারসের গুণাগুণ
আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান আনারসের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন এ। এছাড়াও প্রচুর ফাইবার রয়েছে। শুধু কি তাই, এতে রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। বিশষজ্ঞরা বলছেন, দেহের পুষ্টিসাধন ও দেহকে সুস্থ সবল রোগমুক্ত রাখতে আনারস কার্যকরী। আনারসের উপকারিতা গ্রহণ করে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১ কাপ অর্থাৎ ১৬৫ গ্রাম তাজা আনারসের পুষ্টির পরিমান ক্যালরি ৭৪, পটাশিয়াম ২০৬ মিলিগ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৯.৫ গ্রাম, ফাইবার ২.৩ গ্রাম, সুগার ১৩.৭ গ্রাম, প্রোটিন ১ গ্রাম, ভিটামিন সি ২৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২১ মিলিগ্রাম।
আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এতে থাকা ম্যাঙ্গানিজ খনিজ উপাদন আমাদের দেহের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও পেকপিটন নামক একটি গুরুত্বপূণ্য ডায়েটরি ফাইবার আছে। ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের নানা উপাদান যেমন ফলেট, থায়ামিন, রিবোফ্লোবিন, পাইরিওফিন পাওয়া যায়।
আনারসের আচার কেন খাবেন
আনারস একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। অন্য দিকে আচার তৈরিতে ব্যবহৃত মসলা আমাদের শরীরের জন্য উপকারি। যেহেতু আচার খেতে আমরা সকলেই পছন্দ করে থাকি। তাই মুখোরচক খাবার হিসেবে এটি খাওয়া যেতে পারে। খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি কিছুটা হলেও আমাদের দেহের জন্য পুষ্টিপূরনে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
বদহজমের সমস্যা দূর করে
আনারসের আচার পরিমাণমতো খেলে হজম জনিত সমস্যা হতে মুক্তি পাওয়া যায়। যাদের হজমের সমস্যা রয়েছে তারা এই আচারটি খেতে পারেন। এটি পরিপাকতন্ত্রের রোগ নিরাময় করে।
দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায়
ক্যালসিয়াম আমাদের দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায় বেশ উপকারি। দাঁতকে মজবুত রাখতে আনারসের আচারটি নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দাতেঁর জীবানূ আক্রমন কম হয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে
আনারসে প্রচুর ফাইবার ও অনেক কম ফ্যাট রয়েছে, সালাদ, জুস খাওয়ার পাশাপাশি আনারসের আচারটি খেলেও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
রক্ত জমাটে বাধা
শিরা-ধমনিতে রক্ত জমাট বাধঁলে সারা শরীরে সঠিকভাবে রক্ত চলাচল করতে পারে না। এতে হৃৎপিণ্ড আমাদের শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবারহ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। আনারস রক্ত পরিষ্কার করে, এবং রক্ত জমাট বাধতে দেয় না। তাই এই আচার খেলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হবে। সেই সাথে হৃৎপিণ্ডের কাজ করতে সাহায্য করে।
হাড় গঠনে
আনারসে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে। এটি দুটো খনিজ পদার্থ হাড়ের গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমিতি পরিমাণে আনারসের আচার রাখলে হাড়েরর সমস্যা জনিত রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
ক্ষুধামন্দায় আনারসের উপকারিতা
যাদের খাবার খেতে ইচ্ছে করেনা। খাবারের প্রতি অনিহা রয়েছে। তারা চাইলে আনারসের আচারটি খেতে পারেন। এটি ক্ষুধামন্দা দূর করে খাবারের প্রতি রুচি বাড়িয়ে তোলে।
কৃমি দূর করতে
কৃমি জনিত সমস্যা দূর করতে আনারস বেশ উপাকরি। কেউ চাইলে এই আচারটিও খেতে পারেন।
জ্বরে চিকিৎসায়
আবহাওয়া পরিবর্তেনের কারণে আমরা অনেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকি। ফলে দেখা যায় জ্বর- সর্দি, এই সমস্যা রোধ করতে আনারস সহায়ক।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
আনারস আচার কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে করে থাকে। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর ফাইবার যা দীর্ঘদিনের কোষ্ঠিকাঠিন্য সমস্যাকে রোধ করে। যাদের এই সমস্যা রয়েছে আনারসের আচারটি খেতে পারে।
চোখ ভালো রাখতে
আমাদের দেহের অমূল্যবান সম্পদ হলো চোখ। মূলত ম্যাক্যুলার ডিগ্রেডেশন নামক রোগটি আমাদের চোখের রেটিনা নষ্ট করে দেয় এবং ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যায়। আনারসে থাকা বেটা ক্যারোটিন এই রোগটি প্রতিরোধ করে। তাই আচারটি খেলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। চোখ ভালো রাখতে এই আচারটি খাবারের তালিকায় যোগ করতে পারেন।
আনারসের আচার এর অপকারিতা
নিচে আনারসের আচারের অপকারিতা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অ্যালার্জীর আক্রমণ
যাদের অ্যালার্জী সমস্যা রয়েছে তারা এই আচার খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এবং এই আচার খাওয়া ফলে অ্যালার্জীর উপসর্গ দেখা দিলে আচারটি পরিহার করবেন।
ডায়াবেটিস রোগীরে জন্য ক্ষতিকর
রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে ইনসুলিনের ঘাটতি দেখা দেয়। যেহেতু আনারসে চিনির উপাদান রয়েছে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা নেই তারা পরিমাণ মতো আনারসের আচার খেতে পারবেন।
গর্ভবতি নারীদের জন্য ঝুকিপূর্ণ
গর্ভাবস্থায় থাকলে নারীদের আনারস খেতে বারণ করা হয়। এতে গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই আনারসের আচার খাওয়ার আগে শরীরের অবস্থা বুঝে ডাক্তারে সাথে পরামর্শ নিতে হবে।
বাতের ব্যাথার সমস্যা
যাদের বাতের ব্যথা আছে তাদের আনারসের আচারটি না খাওয়াটাই ভালো। কারণ আনারস গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল নালির কাছে পৌঁছানোর পরে এটি অ্যালকোহলে পরিণত হতে পারে।
উপরিউক্ত আলোচনায় আনারসের আচার কি, গুনাগুন, এর অপকারিতা ও বানানোর রেসিপি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। লেখাটি পড়ে আপনি রসালো আনারস সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন।