You are currently viewing পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের  ঐতিহ্য
পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ

পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের  ঐতিহ্য

পহেলা বৈশাখ, বা বাঙালির নববর্ষ, এটি অনেকের কাছেই শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ, তবে বাঙালির কাছে এটি  সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আবেগের একটি প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন কাল থেকেই খুবই আনন্দের সাথে এই দিন টি উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে। আর পহেলা বৈশাখের খুবই জনপ্রিয় বা প্রধান খাবার হলো পান্তা ইলিশ। 

তবে ঠিক কবে থেকে বাঙালিদের এই বৈশাখ অনুষ্ঠানে এই পান্তা ইলিশের উৎপত্তি সেটির সঠিক ইতিহাস জানা নেই। আজকের এই ব্লগে আমরা জানবো ঐতিহ্যবাহী  বৈশাখ এবং এটির সাথে পান্তা ইলিশের সম্পর্কের সকল আদ্দ্যোপান্ত। 

বাঙালির আবেগ পান্তা ও ইলিশ  

কথায় রয়েছে মাছে ভাতে বাঙালি। আর বাংলা নববর্ষ মানে বাংলা বছরের প্রথম দিন। তবে একেবারে শুরু থেকেই যে নববর্ষে পান্তা ইলিশ খাওয়া হতো এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় নি। তবে হ্যাঁ যেহেতু বাংলা নববর্ষ সৌরপঞ্জিকা অনুসারে প্রবর্তিত হয় এবং প্রাচীন কালেও কৃষক দের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয় খাবার ছিলো পান্তা ভাত। সে সময় অবশ্য ইলিশ মাছ ছিলো অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশ দামি একটি মাছ। তাই কৃষকদের খাবারের তালিকায় খুব একটা ইলিশ মাছের দেখা মিলতো না। সে সময় তারা বিভিন্ন শাকসবজি বা ভর্তার সাথে পান্তা ভাত খেতো।

তবে অনেকের মতেই গত শতকের আশির দশক থেকেই এই পান্তা ভাত খাওয়ার সূচনা ঘটেছে।   সর্বপ্রথম ১৯৬৭ সাথে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এর শুরু হয়। এখন অব্দি সেই ধারা চলমান। তবে শুরু থেকেই এই পান্তা ইলিশ এর প্রচলন না থাকলে আশির দশকে ১৯৮০ আবার কারো মতে ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম পান্তার সাথে ইলিশের আয়োজন করা হয়। একটি সংবাদ মাধ্যম থেকে পাওয়ায় তথ্যমতে  সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন সর্বপ্রথম এই পান্তা ও ইলিশের প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে সহকর্মীদের থেকে চাঁদা তুলে এই আয়োজন সম্পূর্ণ করা হয় এবং এখানে ব্যাপক সাড়া ও পাওয়া যায়। এর পরের বছর থেকেই এটি ক্রমশই জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

এরপর নব্বই এর দশকে এসে পান্তা ইলিশ যেনো বাঙালিদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। ঠিক এই কারনেই তখন শুধু  রমনা তে না বরং সারা বাংলাদেশের সকল জেলা শহরের অলিগলিতেও মানুষ নববর্ষে পান্তা ইলিশ খাওয়া শুরু করে। এতে করে সারা বছরের তুলনায় এই নববর্ষে ইলিশের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুন পর্যন্ত। দাম যেমন ই হোক না কেন, শখ কি আর দাম মানে বলুন। তাই তো আজও নববর্ষে বাঙালিরা ভর্তা ও পান্তার সাথে ইলিশ খেতে ভোলেন না। সারা বছরে নদী থেকে যতো ইলিশ ধরা হয় তার প্রায় ৬০-৭০% এই  মার্চ এপ্রিলে শুধু মাত্র নববর্ষ উপলক্ষ্যে নিধন করা হয়। ঠিক এই কারনে যেনো সকলের ইলিশের চাহিদা মেটানো যায় তাই আমাদের দেশে সরকার কর্তিক একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয় মাছ ধরার জন্য। এই সময়ের বাহিরে কেউ জাটকা নিধন করলে হতে পারি আইনি শাস্তি।

পান্তা ইলিশ খাওয়ার উপকারিতা

পান্তা ভাত ও ইলিশের  ঐতিহ্য ও উপকারিতা

পান্তা ভাত আমাদের স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বেশ উপকারী। পান্তা ভাতে রয়েছে প্রোবায়োটিক উপাদান যা আমাদের দ্রুত খাবার হজমে সাহায্য করে। এছাড়া এটি আমাদের শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে। গরমের দিনে পান্তা ভাত খেলে এটি আমাদের শরীর কে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও পান্তা ভাতে রয়েছে আয়রন। খনিজ উপাদান ও ভিটামিন বি যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী।

অন্যদিকে ইলিশ এটি শুধু আমাদের কাছে একটি সাধারন মাছ না বরং আমাদের ঐতিহ্য এবং আবেগের   এর প্রতীক। ইলিশ বিখ্যাত এটির অসাধারণ ঘ্রাণ ও স্বাদের কারণে। এছাড়াও এটি আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এই মাছে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যা আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

বৈশাখি আয়োজনে পান্তা ইলিশ

বৈশাখের প্রধান আয়োজন বা বৈশাখি খাবার বলতেই এই পান্তা ও ইলিশ কে বোঝানো হয়ে থাকে। প্রতি বছর এই দিনে সকাল বেলায় সবাই পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধবের সাথে  পান্তা ইলিশ খেয়ে থাকে। বীশেষ করে ঢাকার রমনা বটমূলে এই আয়োজন যেনো এক মহাউৎসবে পরিণত হয়। রমনা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে পান্তা ইলিশের আয়োজনের সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও করা হয়।  এমনি বিভিন্ন বড় হোটেল বা রেস্তোরাঁ তেও এই দিন পান্তা ইলিশের দেখা মিলবে। শুধু পান্তা ইলিশ ই না বরং এর পাশাপাশি আরও নানা পদের ভর্তা ও তৈরি করা হয় এই পান্তা খাওয়ার স্বাদ টাকে বাড়ানোর জন্য।  

বৈশাখের বৈশাখি মেলা

পহেলা বৈশাখ অথচ মেলা হবে না তা কি হয় বলুন। পহেলা বৈশাখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই মেলার দেখা মেলে। গ্রামের মেলা গুলো তে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় মাটির জিনিসপত্র, পুতুল নাচ  ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন পন্য সামগ্রির। এছাড়াও বৈশাখি মেলায় বায়োস্কোপ একটি অতি প্রাচীন বিনোদনের নাম। যদিও বা এখন এই বায়োস্কোপের দেখা মেলা না। তবে দলছুট ব্যান্ড এর সেই বিখ্যাত গানটি এখনো অনেকের মন ছুঁয়ে যায়। 

“তোমার বাড়ির রঙের মেলায়

দেখেছিলাম বায়োস্কোপ

বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়েনা!!”

এছাড়াও নববর্ষে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই রমনার বটমূলে সমবেত কণ্ঠে ও বাণীতে বসন্ত কে বরন করে নেওয়া হয়। “ এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!”  এসময় সকলের সমবেত কণ্ঠ যেনো এক অন্যরকম আবহের সূচনা করে। প্রতিবছর ঢাকায় ছায়ানটের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে নতুন রুপে বাংলা বর্ষকে বরন করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা নিশ্চয় শুনেছেন। বাংলা সংস্কৃতির এর খুবই পরিচিত একটি বিষয় এটি। এই শোভাযাত্রা শিশু বৃদ্ধ সহ প্রায় সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। সকলের পড়নে সাদা ও লাল রঙের পোশাক যেনো   এক আলাদা সৌন্দর্য এর মাত্রা যোগ করে। 

পান্তা ইলিশ

পান্তা ইলিশের বিতর্ক ও বাস্তবতা

প্রতি বছর বর্ষবরণে এই পান্তা ইলিশ নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়।  এর প্রধান কারণ হলো ইলিশের দাম। সত্যি বলতে আজও নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিবদের হাতের নাগালে নেই এই মাছ। আর পহেলা বৈশাখ শুরুর আগেই এই মাছের দাম যেন দ্বিগুণের এরও বেশি বেড়ে যায়। ফলে উচ্চবিত্ত ছাড়া  অন্য অনেক সাধারণ জনগণের হাতের নাগালে চলে যায় এই ইলিশ। এই বিষয় টি নিয়েই অনেকের মাঝে বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তবে অনেকের মতেই শুধু মাত্র উৎসবের জন্য ইলিশের উপরে চাপ সৃষ্টি করা উচিত না বরং কীভাবে ইলিশ সংরক্ষণ করা যাবে ও ন্যায্য দামে সকলের হাতের নাগালে পৌঁছানো যাবে সেই বিষয়ে কাজ করা উচিত। এছাড়া অনেক ঐতিহাসিক দের মতে পান্তা ইলিশ বৈশাখের  প্রধান খাবার না। কীভাবে এই খাবার টি আমাদের বৈশাখের প্রধান খাবার হলো তা নিয়ে তারা বেশ বিতর্কে জড়িয়ে পরেন। 

উপসংহার

পান্তা ইলিশ নিয়ে যত বিতর্ক বা সমালোচনায় থাকুক না কেন এটি বাঙালির  একটি প্রাচীন ঐতিহ্য ও আবেগের প্রতীক। প্রতি বছর বগু মানুষ অপেক্ষা করে প্রিয়জনের সাথে এই দিন টি উৎযাপনের জন্য। এই কারণে বছরের এই প্রথম দিনে রয়েছে সরকারি ছুটির ঘোষণা।  নতুন বছর আমাদের জীবনে একটি নতুন অনুভূতি এর সৃষ্টি করে।বৈশাখের  তীব্র  তাপদাহে যখন প্রকৃতি পুরতে থাকে তখন এই পান্তা ভাত ই যেন আমাদের মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। আর সাথে যদি থাকে ইলিশ মাছ ও বাহারি পদের ভর্তা তাহলে তো বৈশাখের মজা বেড়ে হয় দ্বিগুণ। প্রিয়জনদের সাথে বৈশাখ কাটুক আপনাদের আরও আনন্দে এই প্রত্যাশায়  রইলো।আশা করছি আজকের এই লেখার মাধ্যমে আপনারা বৈশাখের প্রধান আয়োজন পান্তা ও ইলিশের সকল আদ্দ্যোপান্ত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছেন।