You are currently viewing মুক্তাগাছার মন্ডা কেন বিখ্যাত? মন্ডার ইতিহাস ও রেসিপি

মুক্তাগাছার মন্ডা কেন বিখ্যাত? মন্ডার ইতিহাস ও রেসিপি

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন কারণে পরিচিতি লাভ করে। এদের মধ্যে মুক্তাগাছা মন্ডার কারণে দেশে বিদেশে সমান ভাবে পরিচিতি পেয়েছে। তো মন্ডার ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং প্রসিদ্ধ। ব্রিটিশ আমল প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে গোপাল পাল নামক একজনের দ্বারা এই সুস্বাদু মিষ্টান্ন উদ্ভাবিত হয়। 

সন্দেশ সদৃশ মুক্তাগাছার মন্ডা রাজা বাদশা থেকে সকল স্তরের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। আমাদের আজকের লেখায় ময়মনসিংহের মন্ডা বিখ্যাত কেন, এর ইতিহাস এবং তৈরি করার রেসিপি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

মুক্তাগাছার মন্ডা কেন বিখ্যাত?

মুক্তাগাছার মন্ডা কেন বিখ্যাত?

ভোজন রসিক বাঙালি তাদের খাদ্য তালিকায় নান সময়ে বিভিন্ন রকমের বৈচিত্র্য তৈরি করেছে। সুজলা সফলা বাংলাদেশের মাটি এত বেশি উর্বর যে এখানে যে কোন বীজ ফেলে দিলেই তা থেকে গাছ জন্মায়। বিভিন্ন রকম ফলের সমাহার প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে বিরাজ করে।  মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে বেশ বিখ্যাত পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাচাগোল্লা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, কুষ্টিয়া জেলার তিলের খাজা, বগুড়ার দই, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি, কুমিল্লার রসমালাই ইত্যাদি।

আমরা বাঙালিরা মিষ্টি খেতে অনেক বেশি পছন্দ করি। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, বিয়ে, জন্মদিন অথবা কোনো উৎসব পালন করার সময় মিষ্টি না হলে আমাদের চলেই না। এই কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি এবং মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রচলন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলের পূর্বে যে সকল জমিদার এবং রাজা বাংলা শাসন করতো তা ছিল ভোজন রসিক। 

তাদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে যুগে যুগে নানা পদের মিষ্টি জাতীয় খাবার সুপরিচিতি পেয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে বগুড়ার দই, পোড়াবাড়ীর চমচম ও কুমিল্লার রসমালাইের জয় জয়কার শুনেছে। এই সকল মিষ্টান্ন তাদের নিজস্ব গুন এবং স্বাদের কারণে দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে মুক্তাগাছার মন্ডা সমান ভাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। 

মূলত অসাধারণ স্বাদ এবং স্বতন্ত্র গুণাগুণের কারণে এই মন্ডা এত বেশি মানুষের মন জয় করতে পেরেছে। যাইহোক, মুক্তাগাছার মন্ডা একটি অতি জনপ্রিয় মিষ্টি জাতীয় খাবার। যা বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং পরিবার নিয়ে খাওয়ার জন্য অনেক উৎকৃষ্ট। নিচে মুক্তাগাছার মন্ডার ইতিহাস আলোচনা করা হলো। 

মুক্তাগাছার মন্ডার ইতিহাস

প্রায় ২০০ বছর আগে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায় এই ঐতিহাসিক মন্ডার প্রচলন শুরু হয়। জনশ্রুতি আছে গোপাল পাল নামক একজনের কাছে স্বপ্নের মাধ্যমে এই মন্ডা তৈরির আদেশ আসে। পরবর্তীতে তিনি তার আদেশ পালন করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে এই সুস্বাদু খাবার প্রচলন করেন। 

যাইহোক, মন্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল তৎকালীন মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের সময় এই উপমহাদেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসন প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিশ্বাস ঘাতকতার মাধ্যমে তৎকালীন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে পরাজিত করে এবং ক্ষমতা চ্যুত করে। 

সেই সময় গোপাল পাল তার বাবার সাথে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী চলে আসেন। কিছুসময় রাজশাহী থেকে তারপর তারা ময়মনসিংহের অদূরে ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুক্তাগাছায় আসেন এবং তারাটি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে থাকা কালীন এক রাতে গোপাল পাল একটি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে একজন ঋষি তাকে সকালে উঠে একটি চুলা তৈরি করার আদেশ দেন এবং মন্ডা বানানোর জন্য বলেন। 

তিনি পরের দিন সকালে চুলা তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। যখন চুলা তৈরি করা শেষ হয় তখন সেই ঋষি দৈব যোগে সেখানে আসেন এবং চুলার উপর হাত বুলিয়ে দেন। তারপর তাকে মন্ডা তৈরি করার নিয়মকানুন শিখিয়ে দেয়। গোপাল পাল সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে পরে। 

সে প্রথম তৈরি করা মন্ডা উপহার হিসেবে তৎকালীন জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর কাছে নিয়ে যায়। তিনি এই নতুন খাবার মুখে নিয়ে এর স্বাদের কারণে ব্যাপক প্রশংসা করে। এতে গোপাল পালের স্পৃহা বেড়ে যায়। এরপর তিনি একটি দোকান প্রতিষ্ঠা করে এবং নিয়মিত রাজবাড়িতে অন্যান্য মিষ্টির সাথে মন্ডা পাঠাতে থাকেন। 

ধীরে ধীরে রাজদরবার থেকে এই মন্ডার পরিচিতি ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে দরবারে আশা বিভিন্ন অতিথিদের মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা শুরু হয়। সেই সময়কার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি বর্গ বিশেষ করে সুর সম্রাট ওস্তাদ আলা উদ্দিন খাঁ, বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, নেতাজী সুবাষ চন্দ্র বসু, স্টালিন, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাও সেতুংকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, রানী এলিজাবেথ এই মন্ডার প্রশংসা করেছেন। 

একটি খাবারের এত বছর ধরে সুনাম রক্ষা করার পেছনে এর স্বাদ অন্যতম। বর্তমান সময়ে অনেকেই মন্ডা তৈরি করে তা মুক্তাগাছার মন্ডা বলে বাজারে বিক্রি করছে। তবে একমাত্র খাঁটি মুক্তাগাছার মন্ডা শুধু সেখানকার গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মন্ডার দোকানে পাওয়া যায়। এই দোকান মন্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যার কোন দ্বিতীয় কোন শাখা নেই। 

তো ১৯০৭ সালের দিকে গোপাল পাল মারা গেলে বংশ পরম্পরায় তার ছেলে রাধানাথ পাল, রাধানাথের ছেলে কেদার নাথ পাল, কেদার নাথের ছেলে দ্বারিকানাথ পাল এবং বর্তমানে দ্বারিকানাথের ছেলে রমেন্দ্র নাথ পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স মণ্ডা তৈরি করে বিক্রি করছেন। 

বর্তমান সময়ে চিনি এবং দুধের দামের উপর নির্ভর করে প্রতি কেজি মুক্তাগাছার মন্ডার দাম প্রচলিত আছে ৬০০ টাকা করে। প্রসিদ্ধ এই গোপালের মন্ডার দোকানে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কেজির মত মন্ডা বিক্রি হয়। যা পার্সেল হিসেবে দেশ বিদেশে সাপ্লাই হয়। অনেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে গিয়ে মন্ডা খায় এবং বাড়ির জন্য নিয়ে যায়। 

মুক্তাগাছার মন্ডা তৈরির রেসিপি

মুক্তাগাছার মন্ডা তৈরির রেসিপি

মন্ডা যা আদতে হলো সন্দেশ। মূলত আর সকল মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করার মত করেই মন্ডা তৈরি করা হয়। নিচে মুক্তাগাছার মন্ডা তৈরি করার রেসিপি বর্ণনা করা হলো। 

উপকরণঃ দুধ, চিনি, ছানা, এলাচ 

মুক্তাগাছার মন্ডা কিভাবে তৈরি করা হয়?

মন্ডা তৈরি করার জন্য প্রথমে ছানা সংগ্রহ করতে হবে। তো ছানা তৈরি করার জন্য প্রথমে পরিমাণ মত দুধ মাঝারি আঁচে জ্বাল করে নিতে হবে। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দেওয়ার পর দুধে ভিনেগার দিতে হবে। এতে দুধ থেকে ছানা তৈরি হবে। সেই ছানা একটি সুতি কাপড়ে রেখে চেপে পানি বের করে দিতে হবে। 

তারপর তা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। ঝুলিয়ে রাখার কারণে ছানা থেকে অবশিষ্ট পানি বের হয়ে মন্ডা তৈরির উপযুক্ত করে তুলবে। যাইহোক, ছানা তৈরি করা হয়ে গেলে তা একটি পাত্রে ঢেলে নিতে হবে। তারপর সেই ছানার পরিমাণের সাথে মিলিয়ে সমপরিমাণ চিনি মিশিয়ে দিতে হবে। ভালো করে মেশানোর জন্য একটু পরিমাণ দুধ নিয়ে নেওয়া ভালো হবে। 

চিনি মেশানো ছানা এখন নির্দিষ্ট আঁচে কম পক্ষে ২০ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। যখন চিনি থেকে পানি বের হয়ে ছানার সাথে মিশতে থাকবে তখন অনবরত নাড়তে হবে। নেড়ে নেড়ে তরল অবস্থা থেকে আঠালো করে তুলতে হবে এবং সব শেষে যখন সব পানি শুকিয়ে যাবে তখন ছানা নামিয়ে নিতে হবে। মনে রাখবেন এলাচের দানা বা গুঁড়া ছানা ঘন ঘন নাড়ার সময় দিয়ে দিতে হবে। 

এখন এই গরম ছানার মিশ্রণ সুন্দর করে গোল করে আলাদা আলাদা করে নিতে হবে। তারপর সেগুলো একটি সুতি কাপড়ের উপরে রেখে পিটিতে ছোট রুটির মত করে নিতে হবে। তারপর একটির সাথে আরেকটি জোরা লাগিয়ে মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডা তৈরি করতে হবে। 

অন্যান্য মিষ্টান্নের মতই মন্ডা আমাদের দেশে সমানভাবে প্রচলিত। বর্তমান সময়ে অনেক দোকান ভেজাল ভাবে মন্ডা তৈরি করে পরিকল্পিতভাবে এই সন্দেশের বাজার নষ্ট করে আসছে। এছাড়া আমরা অনেকেই এই খাবারের আসল ইতিহাস সম্পর্কে অবগত না। আশা করি লেখাটি পড়ে আপনি মুক্তাগাছার মন্ডা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন। 

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.