কুমিল্লা বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা। শীতলক্ষ্যার পাশে অবস্থিত চাঁদপুর এবং কুমিল্লা অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষর। এখানকার ঐতিহ্য যেমন অনেক পুরোনো তেমনি এখানকার খাবার অনেক বিখ্যাত। বিশেষ করে কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই যা দেশে এবং বিদেশে সমানভাবে প্রচলিত।
সর্বোপরি, কুমিল্লায় তৈরি হওয়া রসমালাই যেমন দেশ সেরা তেমনি এর স্বাদ এবং গন্ধ অতুলনীয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ১৭ টি ভৌগোলিক নিদর্শক পণ্য আছে তাদের মধ্যে কুমিল্লার রসমালাই অন্যতম। তবে অনেকেই গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি আর কুমিল্লার রসমালাই নিয়ে একটু কনফিউস থাকেন। অনেকেই মনে করেন একই মিষ্টি জাতীয় খাবার ইত্যাদি। তবে কিছু টা একই ক্যাটাগরীতে হলেও দেখতে, আকার আকৃতি সহ স্বাদের অনেক পার্থক্য আছে। নিচে এই রসমালাই কেন এত বিখ্যাত এবং এর ইতিহাস সহ তৈরি প্রণালি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
কুমিল্লার রসমালাই কেন বিখ্যাত?
রসমালাই বাঙালিদের অন্যতম জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে একটি। আমরা জানি বাঙালি একটি ভোজন প্রিয় জাতি। বাঙালি সংস্কৃতির শুরু থেকেই নানা মুখরোচক খাবার এই জাতির খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। আমরা যেমন মাছে ভাতে বাঙালি তেমনি বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে নানা পদের খাবারের সাথে মিষ্টান্ন না হলে আমাদের চলেই না।
এদেশের মানুষ যখন কোন আত্মীয় বাসায় যায় তখন মিষ্টান্ন নিয়ে যায়। অন্যদিকে সব ধরনের আনন্দ এবং খুশির খবর উদ্যাপন করার জন্য নানা পদের মিষ্টি প্রয়োজন পরে। বলা যায় মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ছাড়া আমরা সামাজিক ভাবে বেঁচে থাকতে পারবো না। মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে বেশ বিখ্যাত পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মন্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, কুষ্টিয়া জেলার তিলের খাজা, বগুড়ার দই, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি, কুমিল্লার রসমালাই ইত্যাদি।
যাইহোক, আমাদের দেশে বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরি প্রচলিত হওয়ার প্রধান স্থান হলো ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি। সহজ করে বলতে গেলে আজ আমরা যে ধরনের মিষ্টান্ন এর সাথে পরিচিত তা আসলে উৎপত্তি লাভ করেছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। অন্যদিকে এমন কিছু খাবার আছে যা মোঘল আমল থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় বিভিন্ন পদের মিষ্টি, সন্দেশ, দই ইত্যাদি পাওয়া যায়। এদের মধ্যে প্রতিটা পদ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কারণে পরিচিত ও বিখ্যাত। এমনকি আমরা সেই খাবারের নামেই উক্ত এলাকার নামের সাথে বিশেষণ যোগ করি। এমনি একটি সুস্বাদু মিষ্টান্নের নাম রসমালাই। দুধ থেকে তৈরি হওয়া এই সুস্বাদু খাবার বিভিন্ন জেলায় পাওয়া গেলেও কুমিল্লার রসমালাই অন্যদের থেকে একদম আলাদা।
কুমিল্লার রসমালাই সবার থেকে আলাদা হওয়ার কারণ হল প্রধানত এখানেই প্রথমে রসমালাইের প্রচলন শুরু হয়। প্রথম দিকে আজকের রসমালাইের মত গঠন এবং রং ছিল না। তবে স্বাদ এবং গন্ধ ছিল অতুলনীয় এবং রসাতুর। তো অন্যান্য এলাকার রসমালাই থেকে কুমিল্লার রসমালাই আলাদা হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে টেস্ট এবং কোয়ালিটি।
অর্থাৎ কুমিল্লায় রসমালাই আদি পদ্ধতিতে তৈরি হয়। এতে রসমালাইের স্বাদ যেমন অক্ষুণ্ন থাকে তেমনি গুণাগুন সমৃদ্ধ হয়। অন্যদিকে কুমিল্লার রসমালাই শুনলে মানুষের মনে এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়। তাছাড়া এখানে বেশ কিছু প্রাচীন দোকান আছে যারা আদি পদ্ধতি অনুসরণ করে খাঁটি এবং গুণগত মান বজায় রেখে রসমালাই তৈরি করে।
মোটকথা কুমিল্লার রসমালাই স্বাদে এবং গুনে অতুলনীয় হয়। তো কুমিল্লার রসমালাই এত বিখ্যাত হওয়ার পেছনে সাধারণত এই কারণ গুলোই মুখ্য। নিচে এই রসমালাইয়ের ইতিহাস বর্ণনা করা হলো।
কুমিল্লার রসমালাই এর ইতিহাস
রসমালাই বাংলাদেশের সুস্বাদু মুখরোচক খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি এই মিষ্টান্ন বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিয়েবাড়ি, সরকারি প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। মূলত রসমালাই একটি বাঙালি খাবার যার উৎপত্তি হয় ব্রিটিশ আমলে বর্তমান কুমিল্লায় জেলায়।
উনিশ শতকে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকমের মিষ্টির প্রচলন ছিল। তৎকালীন সময়ে রসগোল্লার সাথে মালাইকারী মিশিয়ে বিশেষ ধরনের মালাই রসগোল্লা তৈরি করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই খাবার মানুষের মাঝে প্রচলিত হওয়া শুরু করলে গণ হারে এই মালাই রসগোল্লা তৈরি হতে থাকে। এর দেখাদেখি সে সময় দুধ দিয়ে ক্ষীর তৈরি করে তাতে বড় সাইজের রসগোল্লা ভিজিয়ে ক্ষীরভোগ রসগোল্লা তৈরি করা হতো। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের দিকে রসগোল্লার আঁকার ছোট করে তার নাম ক্ষীরভোগ থেকে রসমালাই করা হয়।
তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায় সর্বপ্রথম এই মিষ্টান্ন প্রচলন করেন। তো ১৯৩০ সালের দিকে বর্তমান কুমিল্লায় মাতৃভান্ডার নামে একটি রসমালাইের দোকান প্রতিষ্ঠা পায়। বাংলাদেশের সব থেকে বিখ্যাত রসমালাই মাতৃভান্ডার দোকানে পাওয়া যায়। তো ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামে দুই ভাই তৎকালীন কুমিল্লায় চলে আসেন। তারপর মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভান্ডার নামে একটি মিষ্টির দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুরদিকে তারা শুধু ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বর্তমানে তাদের উত্তরসূরি এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। কুমিল্লায় মাতৃভাণ্ডার বাদেও শীতল ভাণ্ডার, জলযোগ, পোড়াবাড়ি, জেনিস, অমৃত মিষ্টি ভাণ্ডার, কুমিল্লা মিষ্টি ভাণ্ডার, মিষ্টিমেলা ও ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার সুনামের সাথে রসমালাই তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। এদের মধ্যে ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার ও মাতৃভাণ্ডার সব থেকে বেশি বিখ্যাত।
এই মিষ্টান্নের এত বিস্তৃত সুনামের কারণে অনেকেই ভেজাল যুক্ত রসমালাই তৈরি করার শোরুম প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব দোকানের রসমালাইয়ের স্বাদের সাথে প্রসিদ্ধ দোকানের স্বাদের সাথে আকাশ-পাতাল ফারাক বিদ্যমান। যাইহোক, মাতৃভাণ্ডার ও ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার সব থেকে খাঁটি এবং গুণাগুন সমৃদ্ধ রসমালাই তৈরি করে থাকে।
উৎপত্তির সময় থেকেই এই প্রতিষ্ঠান দুটো নিজস্ব কারিগর দ্বারা ওরিজিনাল স্বাদের রসমালাই তৈরি করে থাকে। এমনকি তাদের রেসিপি যাতে অক্ষুণ্ন থাকে এই জন্য তারা কোন শাখা খোলেনি। মোটকথা, এভাবে তারা এই ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরি করে টা দেশে এবং বিদেশে বিক্রি করে আসছে।
কুমিল্লার রসমালাই তৈরির রেসিপি
কুমিল্লার রসমালাই তৈরি করা আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এটি ততটা সোজা নয়। মূলত আর সকল মিষ্টি তৈরি করার প্রক্রিয়ার মত হলেও রসমালাই তৈরি করতে কিছু বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। নিচে কীভাবে কুমিল্লার রসমালাই তৈরি করা যায় তা বর্ণনা করা হলো।
উপকরণঃ দুধ, চিনি, কনডেন্স মিল্কের কৌটার, কর্নফ্লাওয়ার, গোলাপজল, এলাচ গুঁড়া, রসগোল্লা বা চমচম বা যে কোন ধরনের মিষ্টি
প্রণালীঃ
এই রেসিপিতে ১ কেজি রসমালাই তৈরি করার প্রণালি বর্ণনা করা হয়েছে। তো বর্তমানে প্রতি কেজি রসমালাই কুমিল্লায় ২৬০ টাকা করে বিক্রি করা হয়। এই দাম কোয়ালিটি এবং স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই এর দাম পুরোপুরি নির্ভর করে দুধের দাম ও উপকরনের উপর। যাইহোক, খাঁটি রসমালাই তৈরি করতে হলে প্রথমে খাঁটি দেশি গাভির দুধ সংগ্রহ করতে হবে। যেহেতু আমরা ১ কেজি রসমালাই তৈরি করা শিখব সেহেতু ২ কেজি পরিমাণ দুধ নিতে হবে।
এরপর সেই দুধ কমপক্ষে ২ ঘণ্টা মাঝারি আঁচে জ্বাল দিতে হবে। এই লম্বা সময় জ্বাল দেওয়ার ফলে দুধ ফুটে গাঢ় হবে যা দেখতে একদম মালাইয়ের মত হবে। তো প্রথমে এই জ্বাল দেওয়া দুধ দিয়ে স্পেশাল মালাই তৈরি করে নিতে। যখন দুধ প্রয়োজনমতো জ্বাল হবে তখন সেখানে কনডেন্স মিল্কের এক কৌটার অর্ধেক, ২ চা চামচ গোলাপজল, এলাচ গুঁড়া আধা চা চামচ এবং ২ কাপ চিনি মিশিয়ে নাড়তে হবে।
যত বেশি নারা হবে মালাই তত সুন্দর ঘন হবে এবং দেখতে সুন্দর লাগবে। এখন এই মালাই দুধ আলাদা পাত্রে রাখা কর্নফ্লাওয়ারের সাথে মেশাতে হবে। এখানে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে উপাদান গুলো যেন দলা না বেঁধে যায়। যখন সঠিক ভাবে সকল উপাদান সমেত মালাই তৈরি হবে তখন শুরু হবে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া।
যাইহোক, এখন মালাই মিশ্রণ আলাদা রেখে তাতে পূর্বে তৈরি করা রসগোল্লা যা ছোট ছোট দানার মত তা প্রস্তুত করতে হবে। রসগোল্লা প্রস্তুত হয়ে গেলে তা ধীরে ধীরে মালাই ভর্তি পাত্রে ঢালতে হবে এবং হালকা হালকা করে নাড়তে হবে। এতে মালাই মিশ্রণ ভালো করে রসগোল্লার সাথে মিশবে।