You are currently viewing জামতলার মিষ্টির ইতিহাস, কিভাবে তৈরি করে এবং কেন বিখ্যাত?

জামতলার মিষ্টির ইতিহাস, কিভাবে তৈরি করে এবং কেন বিখ্যাত?

যে চেনে সে কেনে সাদেক গোল্লা- এই স্লোগান নিয়ে যশোরের জামতলার সাদেক গোল্লা যাত্রা শুরু করে। অপারগতা থেকে তৈরি হওয়া এই মিষ্টি খুব দ্রুত আশেপাশের এলাকা থেকে পুরো জেলায় সুনাম অর্জন শুরু করে। ধীরে ধীরে অনন্য স্বাদ ও গুণের কারণে পুরো দেশে অন্যান্য মিষ্টির সাথে সাথে জামতলার মিষ্টিও সুপরিচিতি পায়। আমাদের আজকের লেখায় জামতলার মিষ্টি অথবা সাদেক গোল্লা কেন এত জনপ্রিয় এবং এই মিষ্টির তৈরি করার রেসিপি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। 

জামতলার মিষ্টি কেন বিখ্যাত?

মিষ্টি আমাদের সবার প্রিয় একটি মুখরোচক খাবার। স্বাদে অনন্য এই খাবার বাঙালি ইতিহাসের সাথে সূচনালগ্ন থেকেই জড়িত। বিভিন্ন সময় রুচি ও স্বাদের ভিন্নতার উপর নির্ভর করে হরেক রকমের মিষ্টি তৈরি শুরু হয়। বিশেষ স্বাদ ও আকৃতির কারণে যেমন মিষ্টির নামের ভিন্নতা শুরু হয়েছে তেমনি এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

যেমন কাঁচাগোল্লার জন্য নাটোর জেলা, বালিশ মিষ্টির জন্য নেত্রকোণা ও মণ্ডার জন্য মুক্তাগাছা সারা দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ঠিক তেমনি যশোরের জামতলায় তৈরি হওয়া মিষ্টি বা রসগোল্লা সাদেক গোল্লা নামে দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে। 

সাদেক গোল্লা বা জামতলার মিষ্টি বিখ্যাত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ এটি অন্যান্য মিষ্টি থেকে স্বাদে ভিন্ন। এই মিষ্টি তৈরি করার সময় কোন প্রকারের রাসায়নিক দেওয়া হয় না। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির চুলায় খাঁটি গাভীর দুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরি করা হয়। 

এই কারণে স্বাদে কোন ভিন্নতা থাকে না। এমনকি আপনি ৫ বছর আগে এবং ৫ বছর পরে খেলেও একই স্বাদ পাবেন। মূলত এই অভিন্ন স্বাদের কারণে মানুষের মনে সাদেক গোল্লার জন্য আলাদা জায়গার সৃষ্টি হয়েছে। স্পঞ্জ রসগোল্লা হওয়া সত্ত্বেও এখানে কম রস ব্যবহার করা হয়। এতে প্রায় সকল বয়সের মানুষ সাদেক গোল্লা খেতে পারে। 

অন্যদিকে, সাদেক গোল্লা বা জামতলার মিষ্টিকে (Jamtolar rosogolla) ডায়াবেটিকস রসগোল্লা বলেও অভিহিত করা হয়। কারণ তৈরি করার সময় এই মিষ্টিতে পরিমাণের থেকে কম মিষ্টি দেওয়া হয়। এই কারণে যাদের সুগার সমস্যা আছে তারা অনায়াসে জামতলার মিষ্টি খেতে পারে। তাছাড়া অন্যান্য মিষ্টি খাওয়ার সময় আমাদের মুখ মিষ্টি স্বাদে ভোরে যায় যে কারণে বেশি খাওয়া যায় না। তবে সাদেক গোল্লায় মিষ্টির পরিমাণ সহনশীল মাত্রায় থাকে। 

এই জন্য বেশি পরিমাণ খাওয়া যায়। এর সাথে সাথে দামের দিক থেকে অন্যান্য বিখ্যাত মিষ্টির থেকে এর মূল্য কম। কেজি হিসেবে না কিনেও শুধু খাওয়ার জন্য পিস হিসেবে বা হালি হিসেবে কেনা যায়। অর্থাৎ সহজলভ্যতা ও অনন্য স্বাদের কারণে সাদেক গোল্লা এত জনপ্রিয়। 

জামতলার মিষ্টির ইতিহাস

জামতলার মিষ্টির ইতিহাস

জামতলা বাংলাদেশের সুনামধন্য জেলা যশোরে অবস্থিত। মূলত শার্শা উপজেলার নাভারন-সাতক্ষীরা সড়কের কাছে এই বাজার অবস্থিত। তো এই বাজারে ১৯৫৫ সালের পূর্বে শেখ সাদেক নামে একজন চায়ের দোকান করতো। তার দোকানে সেই সময় মানুষ বসে চা খাওয়ার পাশাপাশি আড্ডা দিত। 

তো চায়ের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সাদেক আলী বিভিন্ন এলাকা থেকে দুধ সংগ্রহ করতো। একদিন কোন কারণে তার দোকানে দুধের সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে তিনি অতিরিক্ত দুধ না নিয়ে ফেরত দিতে চায়। সেই সময় উক্ত দোকানে কুমিল্লার একজন ভদ্রলোক চা খাচ্ছিলেন। এই ঘটনা দেখে তিনি সাদেক আলীকে সেই অতিরিক্ত দুধ রেখে দিতে বলেন। 

সাথে আরও বলেন রাতের দিকে এসে তাকে কীভাবে মিষ্টি তৈরি করতে হয় সে বিষয়ে পরামর্শ দিবেন। যথারীতি রাতে সেই লক আসেন এবং হাতে কলমে সাদেক আলীকে রসগোল্লা বানানো সেখান। সেই থেকে সুনিপুণ দক্ষতায় সাদেক আলী স্থানীয় দেশি গাভীর খাঁটি দুধ দিয়ে তেঁতুল, বাবলা কিংবা বেলকাঠ পুড়িয়ে মাটির চুলায় রসগোল্লা তৈরি করা শুরু করেন। 

ধীরে ধীরে অনন্য স্বাদের এই মিষ্টি আশেপাশের এলাকায় সুনাম অর্জন করা শুরু হয়। সেই সময় সাদেক আলী চা দোকানদার থেকে পুরোদমে মিষ্টির কারিগর হয়ে ওঠেন এবং সাদেক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে দোকান ও কারখানা স্থাপন করেন। 

মহাসড়কের পাশে হওয়ার কারণে সাদেক গোল্লা (Sadek golla) খুব দ্রুত লোকাল এলাকা থেকে যশোর ও সাতক্ষীরা শহরে পৌঁছে যায়। তখন থেকে শুরু হয় এই মিষ্টির সুভ যাত্রা। অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের পর থেকে “যে চেনে সে কেনে সাদেক গোল্লা” শ্লোগানের মাধ্যমে জামতলার মিষ্টির যাত্রা শুরু হয়। 

স্বাদে অনন্য এই মিষ্টি দ্রুত জেলার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকায় পরিচিত লাভ করে। পরবর্তীতে তা দেশের বাইরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে। ১৯৯৯ সালের দিকে সাদেক আলী মারা যাওয়ার পর তার বিজনেস সামলানোর দায়িত্ব বর্তায় তার ছয় ছেলের উপর। আদি সাদেক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশাপাশি তাদের ছয় ভাই মিলে বিভিন্ন এলাকায় আরও পাঁচটি শাখা খুলেছে। 

নির্দিষ্ট কারখানায় সাদেক গোল্লা তৈরি হওয়ার পর তা অন্যান্য নিকটবর্তী শাখায় সরবরাহ করা হয়। মূলত কম দামে খাঁটি ছানার এই সুস্বাদু মিষ্টি খাওয়ার জন্য দূরদূরান্তের ক্রেতা এসকল দোকানে ভিড় করে। প্রতিকেজি সাদেক গোল্লা ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আপনি চাইলে পিস হিসেবেও কিনতে পারবেন যেমন প্রতি পিস ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সাইজের পলিথিনের প্যাকে ৫ টাকা দামের ২০টি, ১০ টাকার ১০টি, ২০ টাকার ৫টি এবং সাদা রঙের ১২ টাকা দামের মিষ্টি ১০টি করে বিক্রি হয়।

অন্যদিকে পিস হিসেব প্যাকেট করেও তা নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করা হয়। যশোর ও সাতক্ষীরা বাদেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাদেক গোল্লার নাম দিয়ে মিষ্টি তৈরি করা হয়। তবে এগুলো গুণগত মানের দিক থেকে নিম্ন মানের হয়। সাদেক আলী এই মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর হলেও তার মৃত্যুর পূর্বে এই বিদ্যা অন্যজনকে শিখিয়ে গিয়েছেন। 

বর্তমানে তিনি এই কারখানার প্রধান কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। এই কারণে এত বছর পরেও এই মিষ্টির স্বাদ এবং গুণগত মান অক্ষুণ্ন আছে। নিচে সাদেক গোল্লা বা জামতলার মিষ্টি তৈরি করার রেসিপি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

জামতলার মিষ্টি কিভাবে তৈরি করে?

জামতলার মিষ্টি কিভাবে তৈরি করে?

জামতলার মিষ্টির প্রধান গুণাগুন হচ্ছে এর অভিন্ন স্বাদ। ছোট বড় সকলেই এই মিষ্টি পছন্দ করে এবং খেতে ভালোবাসে। নিচে জামতলার মিষ্টি অথবা সাদেক গোল্লা তৈরি করার রেসিপি বর্ণনা করা হলো। 

সাধারণত সাদেক গোল্লা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। তাদের মধ্যে দেশি গাভীর খাঁটি দুধ এবং তেঁতুল এবং বেলকাঠ অন্যতম। এর সাথে সাথে রসগোল্লার স্বাদ বজায় রাখতে হলে চুলা ও পাত্র অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ এই সব নিয়ম অবশ্যই পালন করতে হবে। 

উপকরণঃ দেশি গাভীর দুধ, খাঁটি ও কেমিক্যাল মুক্ত চিনি, সুজি, তেঁতুল বা বাবলা কিংবা বেলকাঠের জ্বালানি

মিষ্টি তৈরির রেসিপি ও প্রস্তুত প্রনালী

রসগোল্লা তৈরি করার প্রক্রিয়া প্রায় সবার ক্ষেত্রেই একই। তবে কিছু বিশেষ টোটকা ব্যবহারের কারণে স্বাদে ভিন্নতা টের পাওয়া যায়। তো প্রথমে দুধ ভালো করে জ্বাল করে নিতে হবে। দেশি গাভীর খাঁটি দুধ ১৫ থেকে ২০ মিনিট জ্বাল দিলেই একটি লাল আভা তৈরি হয়। অর্থাৎ সেই দুধ দেখলে মনে হবে যে এখানে হয়তো গুড় মেশানো হয়েছে। 

তো এই লালচে গোলাপি আঁকার ধারণ করলে সেই দুধে টক দিয়ে তা থেকে ছানা তৈরি করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে ছানা যত ভালো হবে মিষ্টি তত সুস্বাদু হবে। যাইহোক, ছানা তৈরি করে নেওয়ার পর সেই ছানা কাপড়ে রেখে ভালো করে চেপে পানি বের করে নিতে হবে। পানি বের হলে তাতে প্রয়োজন মত সুজি ও অল্প পরিমাণ ময়দা দিয়ে ভালো করে নেড়ে নিতে হবে যাতে সব মিশে যায়। 

তারপর সেই ছানা থেকে পরিমাণ মত গোল্লা তৈরি করে নিতে হবে। গোল্লা তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো পরবর্তীতে গরম চিনির সিরায় দিয়ে সিদ্ধ অথবা ভেজে নিতে হবে। গরম সিরায় ভাঁজতে ভাঁজতে গোল্লা গুলো সাদা রং থেকে লালচে রং ধারণ করবে। লাল হয়ে আসলে তা নামিয়ে পূর্বে তৈরি করা রাখা সিরায় ডুবিয়ে রাখতে হবে। 

এতে উক্ত মিষ্টি গুলো রসগোল্লায় পরিণীত হবে এবং এভাবেই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সাদেকের রসগোল্লা বা জামতলার মিষ্টি তৈরি করা হয়।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.

Leave a Reply