ছোটবেলায় মায়ের মুখে নিশ্চই শুনেছেন ঘি খেলে বুদ্ধি বাড়ে। আসলেই কি তাই? ঘি হলো পরিশোধিত মাখন। গরম ভাত কিংবা খিচুড়ির সাথে ঘি যেন খাবারে এক আলাদা স্বাদের মাত্রা যোগ করে। আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি কথা রয়েছে “পদ্মার ইলিশ এবং পাবনার ঘি, জামাইয়ের পাতে দিলে আর লাগে কি?” ঘি এর ব্যবহার টা সেই প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে।
বিরিয়ানি, সেমাই সহ বিভিন্ন ডেজার্ট আইটেম তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত এই ঘি। আমরা প্রায় সকলেই এই ঘি খেয়েছি। তবে ঘি খাওয়ার সময় এক চামচ ঘি দেখে কি কখনো আমাদের মনে প্রশ্ন এসেছে ঘি কী? কীভাবেই বা তৈরি হয় এই ঘি, কোন ঘি খাবেন, ঘি খেলে কি শুধুই উপকার? নাকি অপকার ও রয়েছে! আজকের এই ব্লগে আপনাদের জানাবো ঘি সম্পর্কে সকল বিস্তারিত তথ্য।
ঘি কত প্রকার?
ঘি তৈরি করা হয় তরল দুধ থেকে। আর এই তৈরি পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে ঘি দুই প্রকার।
সরের ঘি বা গাওয়া ঘি।
- ক্রিমের ঘি।
- গাওয়া ঘি কি?
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে স্বরের ঘি নাকি গাওয়া ঘি কোনটা বেশি ভালো! মূলত স্বরের ঘি এবং গাওয়া ঘি একই। গাওয়া ঘি হলো সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং পুরোপুরি ভেজালমুক্ত ঘি। এই পদ্ধতিতে সরাসরি গরুর দুধ সংগ্রহ করে সেই দুধ চুলোয় জ্বাল দিয়ে সর সংগ্রহ করা হয়।
এরপর সেই সর পুনরায় চুলোয় জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় খাটি গাওয়া ঘি। আপনি যদি সঠিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ঘি খেতে চান তাহলে খাটি গাওয়া ঘি হবে আপনার জন্য বেষ্ট অপশন। কড়া জ্বালে এই ঘি তৈরি করা হয় জন্য এই গাওয়া ঘি গুলো বেশ দানাদার হয়ে থাকে এবং এটার ঘ্রাণ এবং স্বাদ কয়েক গুন বৃদ্ধি পায়।
ক্রিমের ঘি কি?
ক্রিমের ঘি তৈরির জন্য কাচা দুধ থেকে মেশিনের সাহায্য দুধ থেকে ক্রিম আলাদা করে নেওয়া হয়। এরপর সেই ক্রিম কে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ক্রিমের ঘি।
গাওয়া ঘি নাকি ক্রিমের ঘি?
আমরা অনেকেই মনে করি যে স্বরের ঘি এবং গাওয়া ঘি এর মাঝে হয়ত বিশাল পার্থক্য আছে। আসলে বিষয় টি তেমন না! এই ঘি দুটোর মাঝে প্রধান পার্থক্য হলো এটি তৈরির পদ্ধতি। ঘি দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসেসে তৈরি করা হয়। তৈরি পদ্ধতির ভিন্ন তার কারণে ঘি এর ঘ্রাণ এবং স্বাদের কিছুটা তারতম্য থাকে।
তবে ঘি এর কালার টা নির্ভর করে জ্বালের উপরে। ঘি যত জ্বালে তৈরি করা যায় এটির কালার ততো গাঢ় হয় এবং মোটা দানা ও তৈরি হয়। ঘ্রাণের দিক থেকে ক্রিমের ঘি এর ঘ্রাণ টা একটু বেশী। গাওয়া ঘি এর ঘ্রাণ হালকা হয়। তবে স্বরের ঘি তৈরি করতে যেহেতু স্বর গুলো জমতে বেশ সময় লাগে এবং অনেক সময় নিতে এই স্বর গুলোকে জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি করা হয় তাই এটি কিছুটা সময় সাপেক্ষ পদ্ধতি। অন্যদিকে মেশিনের সাহায্য দ্রুত ক্রিম থেকে ঘি তৈরি করা যায়। তাই ক্রিমের ঘি এর চেয়ে স্বরের ঘি বা গাওয়া ঘি এর দামটা তুলনামূলক বেশী।
সাদা ঘি নাকি হলুদ ঘি, কোন রঙের ঘি বেশি স্বাস্থ্যকর?
ঘি এর কালার বা রং নির্ভর করে এটি জ্বালের উপর। তবে বাজারে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ ঘি দুইটি কালারে পাওয়া যায়।
- সাদা ঘি- মোষের দুধ থেকে তৈরি হয়।
- হলুদ ঘি- দেশি গরুর দুধ থেকে তৈরি হয়।
সাদা ঘি এর উপকারিতা
সাদা ঘি বা মহিষের দুধের তৈরি ঘি তে চর্বি এর পরিমাণ কম।মহিষের দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম। সাদা ঘি শরীর এর ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, হাড় কে শক্তিশালী করে এবং হৃৎপিণ্ডের পেশির কার্যকলাপ সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে।
হলুদ ঘি এর উপকারিতা
গরুর দুধ থেকে তৈরি হওয়া হলুদ ঘি ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। গরুর দুধে রয়েছে এ২ প্রোটিন যা মহিষের দুধে নেই। তাই মহিষের দুধের তুলনায় গরুর দুধে প্রটিনের মাত্রা বেশী। এছাড়াও গরুর দুধে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, খনিজ উপাদান ও ভিটামিন যা হৃৎপিণ্ড কে ভালো রাখতে এবং কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়াও গরুর দুধে রয়েছে এন্টিব্যাকটেরিয়াল, এন্টিফাংগাল এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের হজমে সহায়তা করে ।
ঘি এর পুষ্টিগুণ
মানবদেহের জন্য ঘি এতবেশি উপকারী যে এই ঘি কে বলা হয় “Tongue Of The God” যেহেতু ঘি তৈরি করা হয় খাটি দুধ থেকে তাই দুধের সকল পুষ্টি উপাদান গুলো ঘি এর মাঝে রয়েছে। ঘি তে থাকা ভিটামিন A, ভিটামিন D, এন্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্যাটি অ্যাসিড, আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। এছাড়াও ঘি’য়ে রয়েছে আরও অনেক পুষ্টি উপাদান। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
- ভিটামিন A: ঘি এর মাঝে বিদ্যমান ভিটামিন A ত্বকের উজ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও ভিটামিন A শরীরের বিভিন্ন অর্গান সুস্থ রাখতে, দৃষ্টিশক্তি ও প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে এবং রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডি আমাদের মজবুদ হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।
- ভিটামিন ই: ভিটামিন ই আমাদের হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এবং এন্টিঅক্সিডেন্ড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ভিটামিন কে: ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাধতে এবং শরীরের হাড় কে মজবুদ রাখতে সাহায্য করে।
- ব্রেইন টনিক: ঘিতে রয়েছে ব্রেইন এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্রেইন টনিক উপাদান যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- এন্টিঅক্সিডেন্ট: ঘি তে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীর কে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড: ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ব্যাটাইরিক অ্যাসিড(Butyric Acid): ব্যাটাইরিক এডিস পাকস্থলির হজম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ঘি এর ক্যালরি
প্রতি ৫ গ্রাম ঘিয়ে রয়েছে –
- ক্যালরি-৪৪.৮ কিলো।
- চর্বি -৮.৯ গ্রাম।
- প্রোটিন -০ গ্রাম।
অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রাম ঘিয়ে থাকলে প্রায় ৯০০ কিলো-ক্যালরি এবং প্রায় ৬০ শতাংশ চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট।
প্রতিদিন কি পরিমান ঘি খাওয়া উচিত ও কখন খাওয়া ভালো?
ঘি স্যাচুরেটেড ফ্যাট নাকি আনস্যাচুরেটেড?
কী! শুনতেই কঠিন মনে হচ্ছে তাই না? ঘি তো আমরা অনেকেই খেয়ে থাকি, কিন্তু এতো কিছু কি আমরা জানি? খাওয়ার জিনিস খাবো। এতো কিছু জানতে হবে নাকি? হ্যাঁ জানতে হবে। সুস্থ ভাবে বাচার জন্য আমাদের সকল খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কেই জানা উচিত। সত্যি বলতে ঘি হলো একটা সুপার ফুড।
ঘি এর বিস্তারিত তথ্য এবং উপকারিতা জানলে সকলেই বাধ্য হবে নিজেদের খাবারে অন্তত ১ চামচ হলেও ঘি রাখার জন্য। তবে ঘি স্যাচুরেটেড ফ্যাট নাকি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট? এটা জানার আগে আমাদের জানতে হবে যে স্যাচুরেটেড ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট আসলে কী!
স্যাচুরেটেড ফ্যাট
স্যাচুরেটেড ফ্যাট কে বাংলাতে বলা হয় সম্পৃক্ত চর্বি। এটি এমন এক ধরনের চর্বি যেখানে কার্বন পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে সম্পূর্ণরূপে পরিপূর্ণ হয়। সাধারণ তাপমাত্রায় এই ফ্যাট সোজা এবং শক্ত অবস্থায় থাকে। সাধারণত প্রাণিজ পণ্য এবং নির্দিষ্ট কিছু তেলে ই স্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায়।
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এর বাংলা অসম্পৃক্ত চর্বি। এটি কার্বন পরমাণুর মধ্যে অন্তত একটি ডবল বন্ধন গঠন করে। ফলে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এটি তরল অবস্থায় থাকে। চর্বিযুক্ত মাছ এবং বাদাম বীজে এই অসম্পৃক্ত চর্বি পাওয়া যায়।
ঘি মূলত স্যাচুরেটেড ফ্যাট। যদিও এতে অল্প পরিমাণে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে তবে এর বেশিরভাগ চর্বি ই স্যাচুরেটেড। এছাড়াও ঘিতে রয়েছে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল এবং পলিআনস্যচুরেটেড ফ্যাট যা আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী।
ঘি-তে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এর পরিমাণ
ঘি তে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এর পরিমাণ নির্ভর করে এই ঘি তৈরির প্রক্রিয়া এবং দুধ বা মাখনের উপরে। তৈরি প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করেও কিন্তু ফ্যাট এর পরিমাণ পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তবে ঘি-তে গড়ে প্রায় ৬০-৬৫% স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। সহজ হিসেব হলো আপনি যদি ১০০ গ্রাম ঘি খান, তাহলে এতে প্রায় ৬০-৬৫% স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকবে।
আমাদের আজকের লেখায় আমরা ঘি কত প্রকার সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশাকরি আপনি লেখাটি পড়ে ঘি সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন।