You are currently viewing কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজার, ইতিহাস ও কিভাবে তৈরি করে?

কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজার, ইতিহাস ও কিভাবে তৈরি করে?

কুষ্টিয়া একটি ঐতিহাসিক জায়গার নাম। এখানে বাংলার ইতিহাসের অনেক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে তিলের খাজার আবিষ্কার তাদের নাম ভোজন রসিকদের কাছে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। সাধারণত রাতের বেলা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কুষ্টিয়ার মিলপাড়া ও দেশওয়ালী পাড়ার কারিগরেরা এই সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা কুষ্টিয়ার তিলের খাজা কেন বিখ্যাত এবং এটি তৈরি করার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করবো। 

কুষ্টিয়ার তিলের খাজা কেন বিখ্যাত?

কুষ্টিয়ার তিলের খাজা কেন বিখ্যাত?

খাজা একটি গ্রাম গঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবার। এই জিনিসটার সাথে ৯০ দশকের সবার আবেগ ও অনুভূতি জড়িয়ে আছে। চিনি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের এই মিষ্টান্ন স্বাধীনতার পূর্বে থেকেই এই দেশে প্রচলিত হয়ে আসছে। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি এই খাবার দেখতে যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ খেতে তেমনি সুস্বাদু। 

এখন গ্রামের মেঠোপথে সাইকেলে করে কটকটি ও খাজা বিক্রি করা হয়। এই খাবারগুলোর স্বাদ এদের বিখ্যাত হওয়ার পেছনে সব থেকে বেশি ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে তিলের তৈরি খাজা এই দেশের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। 

অখণ্ড ভারতবর্ষে তিলের খাজার প্রচলন শুরু হয় যা এখন অবধি রয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এক নামে পরিচিত। খেয়াল করে দেখবেন জলে অথবা স্থলে ভ্রমণের সময় বাস, ট্রেন অথবা লঞ্চে অনেক হকার “তিলের খাজা” বা “কুষ্টিয়ার তিলের খাজা” বলে হাক দিচ্ছে। আসে পাশের সিট থেকে ক্রেতাগণ তখন সেখান থেকে প্যাকেট নিয়ে আগে নকল না আসল তা যাচাই বাছাই করে দেখে। 

যখন নিশ্চিত হয় যে এটি কুষ্টিয়ায় তৈরি তখন আর দ্বিধা না করে কিনে ফেলে। অর্থাৎ মানুষ কুষ্টিয়ার তিলের খাজার অন্ধভক্ত। এই সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে, তিলের খাজা সম্পর্কে কুষ্টিয়ার গর্ব ফকির লালন শাহ্‌ তার গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। তিনি বলেছেন “হায় রে মজার তিলের খাজা, খেয়ে দেখলে নে মন কেমন মজা”, এখান থেকে ধারণা করা যায় এই সুস্বাদু খাবার কেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। 

যাইহোক, কুষ্টিয়ায় তৈরি জনপ্রিয় তিলের খাজা পুরো বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বিক্রি হয়। এই খাজার প্রধান কারিগর কুষ্টিয়ায় অবস্থান করলেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এটি উৎপাদন করা হয়। যদিও সেগুলো আসল না নকল সে সম্পর্কে মানুষ তেমন মাঠা ঘামায় না। শুধু কুষ্টিয়ার তিলের খাজা নাম শুনেই সবাই এটি কিনতে মরিয়া হয়ে পরে।  

কুষ্টিয়ার তিলের খাজার ইতিহাস

কুষ্টিয়ার তিলের খাজার ইতিহাস অনেক পুরোনো। অনেকের মতে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশদের কাছে জিম্মি ছিল ঠিক সেই সময় তিলের খাজার উদ্ভাবন হয়। জনশ্রুতি হিসেবে সেই সময় কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায় ও দেশওয়ালী পাড়ার কিছুসংখ্যক পাল সম্প্রদায়ের পরিবার বাস করতো। মূলত তারাই প্রথম দিকে এই খাজা তৈরি করা শুরু করে। 

তারপর তাদের হাত ধরে ধরে পরবর্তী প্রজন্ম এই খাজা তৈরি করা শুরু করে। তিলের খাজা তৈরি করার কারখানা অন্য সকল কারখানার মত করে পরিচালিত করা যায় না। সাধারণত এই সকল কারখানায় মালিক নিজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এখানে যে মালিক সে শ্রমিক এবং যে শ্রমিক সে মালিক। 

আরও সহজ করে বলতে গেলে এক ব্যবসায় কারখানার মালিক নিজে শ্রমিকদের সাথে মিলে খাজা তৈরি করে এবং পরে তা বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে। পরবর্তীতে কারখানায় ফিরে এসে সেই বিক্রির টাকা থেকে খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তা সবাই ভাগ করে নেয়। 

এই কারণে এটি একটি স্বল্প পুঁজির ব্যবসা যা থেকে স্বল্প পরিমাণ আয় আসে। যদিও সুনাম এবং স্বাদের কারণে মানুষের কাছে এটি অনেক জনপ্রিয় কিন্তু সঠিক পরিচর্যা না থাকার কারণে এই ব্যবসা ধ্বংস হওয়ার পথে। যাইহোক, তিলের খাজাকে বর্তমানে একটি ক্ষুদ্রশিল্পের অন্তর্গত করা হয়েছে। অর্থাৎ কুটির শিল্পের মতই এই শিল্প মর্যাদা লাভ করেছে। 

তবে বিভিন্ন মহামারি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় কুষ্টিয়ার তিলের খাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সেখানকার বিখ্যাত ভাই ভাই তিলের খাজার কারখানা বাদে আর সকল পুরোনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে লোণ নিয়ে এই বিজনেস পরিচালনা করা সম্ভব না জন্য নতুন করে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। 

কুষ্টিয়ায় বর্তমানে ছেঁউড়িয়ার আবদুল মজিদ সাহেব সব থেকে বেশি সময় ধরে কারখানা পরিচালনা করে আসছেন। তিনি সাধারণত প্রায় ৮৫ বছর ধরে “১ নম্বর নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা” নামক কারখানা পরিচালনা করছেন যেখানে তিনি প্রধান কারিগর। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কুষ্টিয়ার খাজা সম্পর্কে যে খাজা বেশি চিনে থাকি তা সাধারণত উনার তৈরি খাজা। 

অন্যদিকে চিনির দাম বৃদ্ধির কারণে খাজা তৈরি ও আগের দামে বিক্রি করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করতে চাইলে তা ক্রেতার বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এই কারণে পরিমাণ ঠিক রেখে ১০ টাকায় প্রতি প্যাকেট খাজা বিক্রি করা ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হয়। কুষ্টিয়ার তিলের খাজা প্রতি কেজি মান ভেদে ১৮০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

এই জনপ্রিয় খাজা তৈরির ইতিহাস হিসেবে আরও একটি জনশ্রুতি পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছে ১৯০০ সালের দিকে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘তেলি’ সম্প্রদায়ের কিছু পরিবারকে ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে আসে। এখানে তাদের দিয়ে তিল থেকে তেল নিঃসরণ করার কাজে ব্যবহার করা হয়। তেল প্রস্তুত করার কাজের মাধ্যমেই তারা খাজা তৈরি করার পদ্ধতি বের করে ফেলেন। 

পরবর্তীতে দেশ বিভাগ হওয়ার সময় সেই তেলি সম্প্রদায় ভারতে চলে গেলে স্থানীয় কিছু পরিবার খাজা তৈরি করার কারখানা স্থাপন করে। তারপর থেকে তারাই এই ব্যবসার প্রসার করে আসছে। তবে যাই হোক তিলের খাজার ইতিহাস অনেক ঐতিহ্যপূর্ণ। 

কুষ্টিয়ার তিলের খাজা কিভাবে তৈরি হয়?

কুষ্টিয়ার তিলের খাজা কিভাবে তৈরি হয়?

খাজা তৈরি করার পদ্ধতি সহজ হলেও দক্ষতা না থাকলে এই মিষ্টান্ন তৈরি করা অনেক কঠিন। নিচে কুষ্টিয়ার তিলের খাজা তৈরি করার পদ্ধতি আলোচনা করা হলো। 

উপকরণঃ চিনি, পানি, দুধ, তিল 

পদ্ধতিঃ 

তিলের খাজা প্রধানত দুই ধরনের যথাক্রমে চিনি ও গুড় দিয়ে তৈরি করা যায়। এখানে চিনি দিয়ে কীভাবে তিলের খাজা তৈরি করা হয় তা বর্ণনা করা হয়েছে। তো তিলের খাজা তৈরি করার জন্য প্রথমে চিনি, পানি এবং দুধ এক সাথে মিশিয়ে কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। মোটামুটি ১৫ থেকে ২০ মিনিট জ্বাল দেওয়া হলে দানাদার চিনি গলে তা দুধ ও পানির সাথে ভালোভাবে মিশে যায়। 

তারপর সেই উত্তপ্ত চিনির সিরা যাকে স্থানীয়ভাবে লই বলা হয় একটি পাত্রে ঠান্ডা হওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়। ৫ থেকে ১০ মিনিট ঠান্ডা স্থানে থাকার কারণে লইের উত্তাপ কমে যায়। এই মুহূর্তে সেই চিনির সিরা রাবারের মত আঠালো আঁকার ধারণ করে। 

সেই আঠালো সিরা শ্রমিকগণ হাতে নিয়ে একটি বিশেষ আকৃতিতে তৈরি করা আংটার সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ঝুলানোর পরে তা টেনে টেনে লম্বা করার পাশাপাশি বিশেষ পদ্ধতিতে সিরার ভেতরে ফাঁকা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয় যা দেখতে বাঁশের ভেতরে যেমন ফাঁপা থাকে তেমন দেখা যায়। 

পরে সেই টেনে লম্বা করা চিনির সিরা একটি সমান্তরাল টেবিলে রাখা হয়। কিছু সময় পর সেই লম্বা আঠালো মিশ্রণকে সাইজমত কাটা হয়। এরপর আঠালো থাকা অবস্থায় সেগুলোতে হাতের মাধ্যমে তিল যোগ করা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি খণ্ড তিলের স্তূপে ঢুকিয়ে হাত দিয়ে ঘসে ঘসে জোড়া লাগানো হয়। 

এভাবেই কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা স্বল্প সময়ে তৈরি করা হয়। যা পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হকারের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। তবে আমাদের দেশে মিষ্টি জাতীয় খাবার অঞ্চলভেদে একেক ধরনের খাবারের জন্য বিখ্যাত। যেমন বগুড়ার দই, পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই ইত্যাদি। আবার এই খাবার গুলো বিখ্যাত হবার অনেক ইতিহাস ও রয়েছে।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.

Leave a Reply