ঘি সরাসরি খাওয়ার পাশাপাশি তেল হিসেবে রান্নায় ব্যবহার করা যায়। পিওর গাভির দুধ থেকে তৈরি হওয়া ঘি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি এর পুষ্টিগুণ অনেক। এই কারণে অনেক বছর আগে থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে এই খাবার এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটি শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্য অনেক জরুরি। আমাদের আজকের লেখায় আমরা বাচ্চাদের ঘি খাওয়া উচিত কি না এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।
বাচ্চাদের কি ঘি খাওয়া উচিত?
বাচ্চাদের অবশ্যই ঘি খাওয়া উচিত। শুধু ঘি নয় বাচ্চাদের জন্য দুগ্ধজাত খাবার বরাবরই অনেক উপকারী। বিশেষ করে খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে তৈরি করা ঘি শিশুদের জন্য প্রায় মায়ের বুকের দুধের কাছাকাছি পুষ্টি সরবরাহ করে।
সাধারণত ঘি ভিটামিন এ এর একটি ভরপুর ভাণ্ডার। যা দৃষ্টিশক্তি, ত্বক ও জীবনী শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে। অন্যদিকে ঘিতে থাকা ভিটামিন কে একটি বাচ্চার শারীরিক গ্রোথ ও উন্নতি সাধন করে। তাছাড়া এই দুগ্ধজাত খাবারে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট যা শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক সবার অনেক কাজে লাগে।
তো যখন একটি বাচ্চার বয়স ৬ মাস পার হয় তখন পুষ্টিবিদদের মতে নিয়মিত খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে ঘি মিশিয়ে দেওয়া অনেক ভালো। কারণ এই সময় বাড়তি খাবারের পাশাপাশি পুষ্টিকর উপাদানের প্রয়োজন পরে যা শিশুর সর্বোপরি বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে।
বিভিন্ন শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে একটি বাচ্চাকে সঠিক ভাবে গড়ে তোলার জন্য তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা জরুরি। তাছাড়া বিভিন্ন অসুখের সাথে লড়াই করার জন্য যে টুকু শারীরিক ও মানুষিক শক্তি দরকার তা ছোট বেলা থেকেই শিশুর মধ্যে দিয়ে দিতে হবে।
এই বিষয়ে সাধারণত বাবা মায়েদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আবহাওয়াগত কারণে অনেক মায়ের বুকে পরিমিত দুধ আসে না। যা একটি নবজাতকের জন্য সব থেকে খারাপ খবর। এই সময় আমাদের বিভিন্ন সাহায্যকারী খাবারের শরণাপন্ন হতে হয়।
ডক্টরদের মতে ০-৬ মাস সময়ে বাচ্চাকে বাইরের খাবার থেকে দূরে রাখতে হয়। তারপর সময় থেকে বাচ্চার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গ্রোথ বিকশিত হয়। এই সময় তাকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হয় জাতে শরীরের হাড়, মস্তিষ্ক সহ অন্যান্য অঙ্গ পরিপূর্ণ বিকশিত হয়।
কারণ অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চা খুব সহজেই রোগাক্রান্ত হতে পারে। আবার এই বয়সে ছোট বাচ্চার চিকিৎসা করানো সহজ হয়না। অন্যদিকে চাইলেই খাবারের মাধ্যমে দ্রুত পুষ্টি বৃদ্ধি করা যায় না। তবে কিছু সুপারফুড আছে যেগুলো স্বাভাবিক খাবারের সাথে দিয়ে এই সমস্যা নিরসন করা সম্ভব।
যাইহোক, একজন নবজাতক বাচ্চার যখন ৬ মাস পার হবে তখন থেকে অল্প পরিমাণে খাবারের সাথে ঘি খাওয়ানো যাবে। যদিও পূর্বে একটি ধারণা ছিল যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট হার্টের রোগ তৈরি হওয়ার সব থেকে বড় কারণ। এই জন্য অনেকেই দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করার উপদেশ দেয়। তবে বর্তমানে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে পরিমিত স্যাচুরেটেড ফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী।
তো ঘিতে যথেষ্ট পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের সাথে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৯ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এগুলো বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত রাখে। তাছাড়া ঘিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এগুলো ছাড়াও ঘিতে প্রয়োজনীয় মিনারেল উপাদান থাকে যা বাচ্চার হাড় শক্ত করে, দেহের গঠন উন্নত করে, স্মৃতিশক্তি প্রখর করা সহ অনেক উপকারী কাজ করে।
বাচ্চাদের জন্য ঘি এর উপকারিতা


বাচ্চাদের জন্য দুগ্ধজাত পণ্য তথা ঘি কতটা উপকারী তা নিচে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।
ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
একটি বাচ্চার জন্য তার মায়ের বুকের দুধের উপরে আর কোন খাবার নেই। এখান থেকেই উক্ত শিশু তার বেড়ে ওঠার এবং বেঁচে থাকার সকল রসদ সংগ্রহ করে। যাইহোক, যখন একটি শিশু মায়ের বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয় বা কমিয়ে দেয় তখন তাকে বুকের দুধের পুষ্টিগুণের সমান সহকারী খাদ্য দিতে হয়। না হলে বাচ্চা ধীরে ধীরে পুষ্টিহীনতায় পরে স্বাস্থ্য ও ওজন সংকটে পরবে।
যা তার শারীরিক গঠনে অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি কার্যকরী উপাদান হলো ঘি। ঘি তে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, চর্বি ও ক্যালরি থাকে। যা শিশুর দেহের ওজন বৃদ্ধি করে তাকে স্বাভাবিক রাখে।
হাড়ের গঠন উন্নত করে
ঘিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে মিনারেল উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, জিংক ইত্যাদি থাকে। এগুলো যেমন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে তেমনি ক্যালসিয়াম শিশুর দেহের সকল হাড়ের গঠন নিশ্চিত করে। যেহেতু শিশু বয়সে দেহের হাড় গঠন শুরু হয় সেহেতু এই সময় যদি দুর্বল ভাবে হাড়ের স্ট্রাকচার তৈরি হয় তবে তা পরবর্তীতে নানা সমস্যা তৈরি করবে।
তাছাড়া পুরো শরীর টিকে থাকা যেমন হাঁটাচলা করা ও কায়িক পরিশ্রম করার জন্য সুস্থ সবল হাড়ের গঠন অতি জরুরি যা শিশু বয়সে গঠিত হওয়া শুরু হয়। তাছাড়া ঘিতে থাকা ভিটামিন ডি ও কে ক্যালসিয়াম তৈরি করতে সাহায্য করে। যা একটি শিশুর জন্য অনেক জরুরি।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ঘি তথা দুগ্ধজাত পণ্য এন্টিঅক্সিডেন্ট ও এন্টিমাইক্রোবিয়াল এর কারখানা হিসেবে কাজ করে। আর এই উপাদান গুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক অনেক বৃদ্ধি করে। বিশেষত এন্টিমাইক্রোবিয়াল দেহে কোন রোগ থাকলে তা বিস্তার হওয়া থেকে রোধ করে। অর্থাৎ পূর্বে থাকা কোন রোগের জীবাণু ধ্বংস করে।
অন্যদিকে এন্টিঅক্সিডেন্ট দেহে নতুন কোনো রোগের জীবাণু প্রবেশ করা থেকে রক্ষা করে। এতে নতুন কোনো রোগ দেহে প্রবেশ করে না এবং পুরাতন রোগ নিরাময় হয়। একটি বাচ্চার জন্য এই সুবিধাটুকু অনেক প্রয়োজনীয় যা পরিমিত ঘি খাওয়ার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।
হজম শক্তি বৃদ্ধি করে
দুধ দিয়ে তৈরি হওয়া সকল খাবার হজমে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে দই ও ঘি এই ক্ষেত্রে সব থেকে উপরে আছে। যাইহোক, ঘি যখন একটি আনুশের পাকস্থলীতে প্রবেশ করে তখন তা হজমে সহায়ক এনজাইম ও অণুজীবগুলোকে সক্রিয় করে।
তৎক্ষণাৎ পেটের মধ্যে থাকা দূষিত পরিবেশ তথা অ্যাসিডিক সমস্যা দূর করে ও হজম বৃদ্ধি করে। তাছাড়া ঘিতে থাকা বুটিরিক অ্যাসিড হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এটি বাচ্চাদের জন্য অনেক উপকারী হিসেবে কাজ করে।
প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করে
ঘি থে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক ও ফসফরাস সহ অনেক মিনারেল থাকার পাশাপাশি ভিটামিন এ, বি, ডি, কে ইত্যাদি ভিটামিন বিদ্যমান। এগুলো মানবদেহ তথা শিশুর প্রথম পর্যায়ের গ্রোথের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত কাজ করে। এই কারণে যখন শিশু বয়সে ঘি খাওয়া হয় পরবর্তীতে দেহে ভিটামিন ও মিনারেলের কোন ঘাটতি পরে না।
শিশুর শুকনো কাঁসি দূর করে
শিশুর শরীর সবসময় একটি সেন্সেটিভ হয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে অথবা ধুলো বালির কারণে তারা অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পরে। বিশেষ করে কাঁসি হওয়া শিশুদের অনেক কমন একটি ব্যাপার। এটি প্রাপ্তবয়স্কদের যেমন অনেক কষ্ট দেয় তার থেকে বেশি শিশুদের কষ্ট দেয়। তবে নিয়মিত পরিমাণ মত ঘি খেলে তা শুকনো কাঁসি দূর করতে সহায়তা করে। তবে শিশুকে খাওয়ানোর সময় হালকা গরম পানিতে দুই চামচ মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
চুলকানি নিরাময় করে
সারাদিন শুয়ে থাকার কারণে এমন নিজে থেকে নড়াচড়া না করার কারণে শিশুদের শরীরে বিভিন্ন সময় চুলকানি, ফুসকুড়ি অথবা একজিমা হতে পারে। যখন এই সমস্যা দেখা দিবে তখন আক্রান্ত স্থানে ঘি তেলের মত করে মেখে দিলে উপকার পাওয়া যায়। মূলত শিশুর দেহ অনেক নাজুক থাকে এবং এই সময় ঘিতে থাকা এন্টিমাইক্রোবিয়াল জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। এতে সকল ধরনের ফুসকুড়ি ও চুলকানি দূর হয়ে যায়।
থাইরয়েড গ্রন্থি সচল রাখে
মানবদেহে হরমোনের কাজ অনস্বীকার্য। আর এই হরমোন উৎপাদিত হয় দেহের বিভিন্ন স্থানে থাকা গ্রন্থি থেকে। এই সকল গ্রন্থির কার্যকারিতা পরিচালনা করে আয়োডিন নামক খনিজ উপাদান। দুগ্ধজাত পণ্য ঘিতে এই উপাদান প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। যা থাইরয়েড গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এটি শিশু দেহের বিকাশে সব থেকে বেশি সহায়তা করে।
ঠাণ্ডার সমস্যা দূর হয়
ঘি বরাবরই ঠাণ্ডার সাথে সাংঘর্ষিক আচরণ করে। কারণ ঘি যখন খাওয়া হয় তখন তা দেহের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে এবং শরীর উষ্ণ রাখে। এতে জমে থাকা কফ পরিষ্কার হয় যা শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে সর্দি থেকে মুক্ত করে।
মস্তিষ্কের গঠন দৃঢ় হয়
আমরা জানি মস্তিষ্কের কোষ এবং নিউরন গুলো চর্বি এবং ফ্যাটি অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। শিশু বয়সে ঘি খাওয়া হলে এতে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট মস্তিষ্ক সুগঠিত করতে সাহায্য করে। তবে মনে রাখতে হবে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে ঘি খেতে হবে তবে বিশেষজ্ঞ অনেক পুষ্টিবিদের মতে প্রথম জন্মদিনের পর থেকে ঘি খাওয়া উচিত এবং এতে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।


বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর বিকাশে প্রাকৃতিক পুষ্টির সেরা উৎস
– খাঁটি ঘি
এছাড়াও ঘি রুপচর্চা সহ নিত্য দিনের অনেক সুস্বাদু রান্নায় ব্যবহার করা যায় ভালো মানের খাটি ঘি। ঘি এর পুষ্টি গুন ও উপকারিতা জানতে এই আর্টিকেল থেকে জেনে নিতে পারেন।
বাচ্চাদের জন্য কোন ঘি ভালো?
বাচ্চাদের বিষয়ে আমাদের সব থেকে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। বিশেষ করে তাদের খাদ্য তালিকা এবং পুষ্টিমানের দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। না হলে অনেক অযাচিত ঘটনা ঘটে যায় যা হিতে বিপরীত হয়। যাইহোক, বাচ্চাদের জন্য সব সময় সুষম খাদ্য বেছে নিতে হয়। যে খাবারে কোন ধরনের ফরমালিন, রাসায়নিক ইত্যাদি নেই অর্থাৎ অরগানিক খাবার সেগুলো সব থেকে বেশি স্বাস্থ্যকর।
তো শিশুদের জন্য সবসময় অরগানিক ঘি ভালো। বাজারে যে সকল ঘি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অনেক প্রকারের ঘি খাওয়া যায় সমস্যা হয় না। তবে যে সকল ঘিতে চিনি, লবণ অথবা মধু মিশ্রিত আছে সেগুলো ভুলেও বাচ্চাদের খাওয়ানো যাবে না। এতে শিশু দেহের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে যা সংশোধন করা অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়।
বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ ও গবেষকদের মতে A2 লেভেলের দুধ দিয়ে তৈরি ঘি শিশুদের জন্য সব থেকে বেশি স্বাস্থ্যকর। সাধারণত এই লেভেলের দুধ সরাসরি গাভি থেকে দোয়ানো থাকে এবং এতে পর্যাপ্ত ল্যাকটোজেন উপস্থিত থাকে। তাছাড়া এই দুধে সকল ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল উপস্থিত থাকে। মত কথা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে জেন দুধে অথবা ঘিতে কোন ধরনের অন্য উপাদান মিশ্রিত না থাকে।
আজকের লেখায় ঘি কীভাবে একটি শিশুর বিকাশে কাজে লাগে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ঘি কীভাবে একটি শিশুর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুগঠিত করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে। আশা করি লেখাটি পরে আপনি ঘি সম্পর্কিত ভুল ধারণা থেকে বের হতে পেরেছেন।