রসুন একটি মশলাজাতীয় সুপারফুড। এতে রয়েছে মানব শরীরের জন্য অনেক উপকারী পুষ্টি উপাদান। রসুন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডিটক্স করে দেহের ক্ষতিকর উপাদান বের করে দেয়। এছাড়াও রসুন খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধি করে তা মুখরোচক করে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা রসুন কেন খাওয়া উচিত এবং এর উপকারী দিক গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। রসুন একটি সুপারফুড জাতীয় খাদ্য। রসুনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সহ সেলেনিয়াম।
রসুন কেন খাবেন?
রসুনে থাকা এই সেলেনিয়াম উপাদান মানব শরীরে থাকা ক্যানসারের জীবাণু প্রতিরোধ করে। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতায় তাকে চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হতো। বর্তমান সময়ে একে মশলা হিসেবে বিবেচনা করলেও প্রাচীন কালে এর ব্যবহার রোগ সারানোর জন্য করা হতো। যাইহোক, রসুন খাওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কারণ এটি একাধারে যেমন খাবারের স্বাদ বাড়ায় তেমনি এর রয়েছে ওষুধি গুন।
সঠিক নিয়ম মেনে রসুন খেলে তা শরীরের বিভিন্ন পুষ্টিকর কাজে লাগে। এতে যে বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ রয়েছে তা মানব দেহের জন্য অনেক জরুরি। তাছার রসুনে রয়েছে থিয়ামিন (ভিটামিন বি১), রিবোফ্লাবিন (ভিটামিন বি২), নায়াসিন (ভিটামিন বি৩), প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৫), ভিটামিন বি৬, ফোলেট (ভিটামিন বি৯) ও সেলেনিয়াম সহ অন্যান্য পুষ্টিগুণ।
রসুন খাওয়ার নিয়ম
রসুন খাওয়ার নিয়ম হচ্ছে এটি আপনাকে কাঁচা এবং কোয়া আকারে খেতে হবে। রসুন খাওয়ার আদর্শ সময় বলা হয় সকালে খালি বা ভরা পেটে। যদি আপনার খালি পেটে খেলে গ্যাস বা বুক জ্বালাপোড়া করে তাহলে অবশ্যই ভরা পেটে খেতে হবে। আপনার যদি বিশেষ কোন সমস্যার কারণে রসুন না খেতে হয় তবে নিয়মিত সকালে একটি করে কোয়া চিবিয়ে খেতে পারেন।
তবে প্রয়োজন ভেদে ২-৫টি কোয়া খাওয়া যেতে পারে। তাছার এটি যেহেতু রান্না করে খাওয়া যায় সেহেতু পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়েও সেবন করা যেতে পারে। অন্যদিকে, কাঁচা রসুন কুঁচি কুঁচি করে কেটে হালকা ভেজে বা পানি দিয়ে ওষুধের মত গিলেও খাওয়া যায়।
পুষ্টিবিদদের মতে দিনে ২-৩ কোয়া রসুন সকালে বা রাতে খাওয়া সব থেকে বেশি উত্তম। এভাবে খেলে তা শরীরের মাত্রার সাথে খাপ খায় এবং কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে কখনোই অতিরিক্ত পরিমাণে রসুন খাওয়া যাবে না। কারণ অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্ত বেশি পাতলা হয়ে ইন্টারনাল ব্লিডিং, হজম সমস্যা সহ আরও জটিল কোন ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে।
রসুনের উপকারিতা কি?
নিচে রসুনের উপকারিতা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রক্তে উপকারী ও ক্ষতিকর দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে তার মধ্যে এলডিএল কোলেস্টেরল ক্ষতির দিক দিয়ে সব থেকে মারাত্মক অবস্থানে আছে।
কারণ এই উপাদান বেশি পরিমাণে রক্তে থাকলে হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। রসুন রক্তে থাকা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল যেমন এলডিএল এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। যা উপরে বর্ণিত সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে শরীরকে সাহায্য করে।
রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়
বিরতিহীন রক্ত সঞ্চালন মানব দেহকে সুস্থ ও সবল রাখে। কোন কারণে সঞ্চালনে বাঁধা পরলে তা শরীরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে যার মধ্যে হৃদ রোগ সব থেকে বেশি মারাত্মক। নিয়মিত রসুন খেলে তা রক্ত তরল রাখে, এতে শিরা উপশিরায় সঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন হয়। এতে হৃদ রোগ সহ উচ্চ রক্তচাপ সমস্যার সমাধান হয়।
পুরুষের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আমরা আগেই জেনেছি রসুন রক্তের চলাচল গতিকে সবসময় সচল রাখে। এতে দেহের প্রতিটি অঙ্গে সঠিক মাত্রায় রক্ত সঞ্চালিত হয় যা পুরুষের যৌন সমস্যার সমাধান করে। বিশেষ করে ইরেক্টাল ডিস্ফাংশন সমস্যায় রসুন অনেক ভালো কাজ করে।
উচ্চ রক্তচাপ কমায়
রক্তে এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে তা উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়। উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোক থেকে শুরু করে অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। নিয়মিত রসুন খেলে তা রক্তে থাকা এই ক্ষতিকারক এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে।
হৃৎপিণ্ডের শক্তিবর্ধক
হৃৎপিণ্ড আমাদের শরীরের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মস্তিষ্কের পরেই সব থেকে বেশি কাজ করে হৃৎপিণ্ড। কোনো কারণে এর কর্মক্ষমতা কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আর বেচে থাকতে পারবো না। আমরা প্রাকৃতিক উপায়ে হৃদপিণ্ডে থাকা বিভিন্ন সমস্যা নিরাময় করতে পারবো।
বিশেষ করে রসুনে যে যে পুষ্টিগুণ আছে তা হৃৎপিণ্ডের পেশি শক্ত করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত রাখার কারণে কোনো ধরনের ব্লকের সম্ভাবনা থাকলে তা নির্মূল হয়। মোটকথা, রসুন খেলে তা হৃৎপিণ্ড আরও শক্তিশালী করে যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক সহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান করে।
ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে
ফুসফুস মানব দেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বিভিন্ন কারণে এতে সংক্রমণ ঘটে। বিশেষ করে অ্যালার্জি ও ঠান্ডা জনিত কারণে ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটতে পারে। এতে হালকা থেকে অনেক গভীর কাশি হয়। কাশি দেওয়ার সময় বুকে ব্যথা সহ জ্বালাপোড়া হতে পারে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে রসুন অনেক ভালো কাজ করে। রসুনে থাকা উপাদানগুলো ফুসফুসের সংক্রমণ বিস্তার করা রোধ করে।
হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে
হাড়ের ক্ষয় অনেক জটিল একটি সমস্যা। বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন নামে যে ফিমেল হরমোন থাকে তার মাত্রা কমে যায়। এতে মহিলাদের শরীরে হাড় ক্ষয় হতে থাকে। এই হাড় ক্ষয়রোধ করার জন্য প্রয়োজন পরে বেশি বেশি ইস্ট্রোজেন হরমোনের নিঃসরণের। রসুন এই হরমোনের নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে হাড় ক্ষয়রোধ করে। এর সাথে সাথে হাড়ের গঠন আরও শক্তিশালী হয়।
স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরপুর রসুনের আচার!
কোষের ক্ষতিরোধ করে
স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন না হলে বা কোন সংক্রমণ হলে শরীরের কোষ নষ্ট হতে থাকে। এই সমস্যা অনেক মারাত্মক আঁকার ধারণ করে যখন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কোষ মারা যেতে থাকে। নিয়মিত রসুন খেলে কোষের এই ক্ষয় রোধ করা যায়। কারণ রসুনে আছে পর্জাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কোষের ক্ষয়রোধ করতে সহায়তা করে।
দীর্ঘায়ু হওয়া
কাঁচা রসুনে বিভিন্ন রকমরে উপকারী পুষ্টি উপাদান থাকে। যা নিয়মিত সেবন করলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। কারণ নিয়মিত রসুন খেলে দেহের পুষ্টিগুণ মাত্রা স্বাভাবিক হয় এবং দেহের রোগ ব্যাধি অনেক কমে যায়, এতে দীর্ঘায়ু পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ডিটক্স
ডিটক্স এটি দেহের টক্সিক পদার্থগুলো বেড় করে দেওয়ার একটি পদ্ধতি। তিন দিন, পাঁচ দিন, সাত দিন বা পনেরো দিনের রুটিন মোতাবেক দেহ কে ডিটক্স করা হয়। রসুন একটি ন্যাচারাল ডিটক্স হিসেবে কাজ করে। আমরা প্রতিদিন খাবারের সাথে যে ধরনের ক্ষতিকর মেতাল বা উপাদান গ্রহণ করি তা রসুনে থাকা উপাদান দেহ থেকে বেড় করে দেয়। এই কারণে একে সুপারফুডের পাশাপাশি শক্তিশালী ডিটক্স হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রায় অনেক খাবারে এই উপাদান থাকলেও রসুনে এটি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। যা নিয়মিত খেলে দেহের অন্যান্য উপকার হওয়ার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে অল্পতেই অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। যা মানুষকে বেশি সময় কর্মক্ষম রাখে।
শরীরে অবাঞ্ছিত ফোলা বা গোটা
প্রায় সময় আমাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা গোটা ওঠে যা প্রচণ্ড পরিমাণে চুলকায়। রসুনে প্রয়োজনীয় উপাদান থাকার কারণে তা শরীরে থাকা এই ধরনের অবাঞ্ছিত ফোলা বা গোটা নিরাময়ে সহযোগিতা করে।
উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা রসুনের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারলাম। আসা করি লেখাটি পড়ে আপনি রসুনের উপকারী দিক সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন। এছাড়াও রসুন ও সরিষার তেলের উপকারিতা ও অনেক রয়েছে। তাই সুস্থ ও ভালো থাকতে হলে এই সুপার ফুডের কোন তুলনা হয় না।