বয়স বাড়ার সাথে সাথে বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ কমতে শুরু করে। বিশেষ করে শীত এলেই নানান অসুখ বিসুখ শরীরের বাসা বাঁধে। তাই শীতের মৌসুমে বয়স্কদের প্রতি যত্ন ও সচেতন হওয়া উচিত। এই সময়ে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো ঠান্ডা কখনো হালকা গরম। যা আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নষ্ট করে করে। ফলে নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।
যেহেতু প্রবীণব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাই স্বাস্থ্যঝঁকিতে তারাই বেশি পড়েন। প্রবীনসদস্যরা আামাদের বৃক্ষের মতো হয়ে থাকে। তাই শীতে তাদের জন্য বাড়তি যত্ন নিতে হবে। আজকের আর্টিকেলে আমরা শীতে বয়স্কদের কিভাবে পরিচর্যা করতে হবে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
শীতে বয়স্কদের পরিচর্যা
শীতে ঠান্ডা আবহাওয়ার ফলে সর্দিকাশির দ্রুত ছড়িয়ে পরে। বয়স্কদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তাদেরকে বিশেষ নজকে রাখতে হবে। অন্যথায় দ্রুত ঠান্ডাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। বয়স্ক ব্যাক্তিদের পরিচর্যা করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় রয়েছে। নিয়ম মেনে তাদের যত্ন সেবা করলে তারা সুস্থ্য থাকবেন। চলুন উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক-
উষ্ণ রাখুন
প্রচণ্ড শীতে শরীর দ্রুত তাপমাত্রা হারিয়ে যায়। শরীর যতটুকু তাপ উৎপাদন করে যদি তার চেয়ে দ্রুত তাপমাত্রা কমে যায় তাকেই হাইপোথার্মিয়া বলা হয়। পরবর্তীতে শরীরের তাপমাত্রা একেবারেই কমে গেলে মস্তিষ্কে আঘাত করে। তীব্র শীতে বয়স্কদের হাইপোথার্মিয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। তাই শীতকালে বয়স্কদের প্রতি অনেক বেশি যত্নবান হতে হবে। বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে যাওয়া উচিত নয়। যথাসম্ভব ঘরে রাখতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে গেলেও জুতা মোজা, কানটুপি, মাফলার ইত্যাদি শীককালীন পোষাক ব্যবহার করতে হবে। মূলত তাদের উষ্ণ রাখতে যেসকল প্রয়োজন সেগুলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
পোশাক নির্বাচন
শীতকালে বয়স্কদের জন্য আরামদায়ক পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত যেসকল কাপড় শরীরকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করবে সেগুলো বাছায় করতে হবে। শরীর গরম রাখার জন্য সুতি গরম ও আরামদায়ক কাপড় পরিধান করাতে হবে। এবং হাত, পা, বুক কিংবা গলায় সরাসরি বাতাস না লাগে সেই দিকটি লক্ষ রাখতে হবে। প্রয়োজনে হাত পায়ের মোজা ব্যবহার করা যেতে পারে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান
তীব্র শীতে পানি পিপাসা অনুভূত না হওয়ার ফলে প্রয়োজন ছাড়া পানি পান করতে চায়না। সাধারণত অন্য সময়ের চেয়ে শীতকালে পানি খাওয়ার চাহিদা একটু কম থাকে। যা মোটেও ঠিক না। এতে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। যা শরীরকে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে কুসুম গরম পানি পান করানো যেতে পারে।
ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস
পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোবাতাস প্রবেশ করে এমন ঘন নির্বাচন করতে হবে। এতে ঘর গরম থাকবে। শীত কিছুটা কম লাগবে। প্রয়োজনে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে ঘরকে উষ্ণ করা যায় খুব সহজেই।
হালকা ব্যায়াম
নিয়মিত ব্যায়াম করা আমাদের জন্য জরুরি। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হালকা ব্যায়াম করাতে হবে। শীতে বাহিরে বের হতে না পারলেও ঘরেই হাঁটাহাঁটি করাতে হবে। এতে সর্দি কাশি ইত্যাদি রোগ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এছাড়াও শরীরচর্চা করার ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে, শরীরের ব্যথা থাকলে তা উপশম হবে। মেজাজ ভালো হবে ও অবসাদ দূর হবে। এমনকি শরীর থেকে টক্সিক পদার্থ দূর করতেও সাহায্য করবে।
ত্বকের যত্ন
শীতকালে বয়ষ্কদের ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়। ত্বকের যত্নে জেলি, সরিষারর তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ত্বক বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ নিতে হবে।
গোসল করানো
গোসল করার ফলে চর্মরোগ বা ত্বকের সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। শীতকালে বয়স্কদের সপ্তাহে ২-৩ বার গোসল করানো উচিত। প্রয়োজন হলে গোসলের পানি কুমুস গরম করে নেওয়া যেতে পারে। এবং প্রতিদিন ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সবুজ শাকসবজি
শাকসবজির উপকারিতা বহুগুণ। আমাদের দেশে শীতকালে বিভিন্ন রঙের শাকসবজি পাওয়া যায়। যেমন গাজর, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি। এগুলো প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখতে হবে। যা শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব পূরণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
পুষ্টিকর খাদ্য
যেহেতু বসয় ভেদে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই বয়স্কদের জন্য আলাদা একটি সুষম খাবারের তালিকা তৈরি করতে হবে। এবং তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এতে শরীরে শক্তি জোগাবে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যাবে।
ভিটামিন ডি এর অভাব দূর
ভিটামিন ডি এর প্রধাণ উৎস হলো সূর্য। ভিটামিনের অভাব হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এতে করে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হওয়া বেড়ে যায়। তাই ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণের জন্য সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ১০-২০ মিনিট রোদ শরীরে লাগানো যেতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম
শীতকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো উচিত। যারা বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছে তাদের প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে ঠান্ডা কাশি থেকে রেহায় পাওয়া যায়।
ধূমপান ত্যাগ
অনেক বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছে যারা মদ্যপান, ধূমপান বা অতিরিক্ত চা কফি পান করে থাকেন। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দেয়। তাই এই ধরনের অভ্যাস থেকে বিরত রাখতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন
বয়স্ক ব্যাক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এই সময় অনেক বয়স্ক ব্যাক্তিরা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তাই পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের মানসিকভাবে সাপোর্ট দিতে হবে। তাদেরকে যথাসম্ভব আনন্দে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আর্দ্রতা বজায় রাখা
শীতকালে নিজেকে আর্দ্র রাখতে হবে। শরীরের আর্দ্রতা হারালে রোগ বাসা বাধতে পারে। এজন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। যেহেতু বয়স্ক ব্যাক্তিদের শরীরে এমনিতেই শুষ্ক থাকে তাই পানি খাওয়ার কথা ভুললে চলবে না।
শীতে বয়স্কদের বাড়তি যত্ন
শীতকালে বয়স্কদের শারীরিক জটিলতা বেড়ে যায়। তাই এই সময়ে সঠিক যত্ন নিতে হবে। চলুন বাড়তি কিছু যত্ন জেনে নেওয়া যাক-
- খাবার পানি বা ব্যবহারের পানি যেমন অজু, গোসল ইত্যাদিতে কুমুস গরম পানির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
- জ্বর-সর্দি, কাশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- ডাক্তারে পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবেনা।
- নিয়মিত মলত্যাগের অভ্যাস বজায় রাখা জরুরি।
- মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটার পরিবর্তে জুতা বা মোজা ব্যবহার করাতে হবে।
- গুরুত্বর কোনো সমস্যা দেখা দিয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
- সর্দি কাশির সমস্যায় নাক বন্ধ থাকলে উষ্ণ পানি নাক দিয়ে টানার অভ্যাস করতে হবে।
- প্রোটিনযুক্ত খাবার দিতে হবে। এবং চেষ্টা করতে হবে গরম গরম খাবার পরিবেশন করানোর।
- কোনো বয়স্ক ব্যাক্তির হার্টের কোনো অসুখ, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালির প্রদাহ বা অ্যজরা থাকলে তাদেরকে ব্যায়াম করানো যাবে না।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
- রুম হিটার ব্যবহারে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় চামড়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- ব্যবহৃত চাদর, বালিশের কভার নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। এবং ভালো করে রোদে শুকাতে হবে।
- দিনের বেলায় কিংবা রাতে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাবেনা। বাইরেরর হাওয়া সংস্পর্শে এলে সর্দি কাশি ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
- শরীরকে চাঙা রাখার জন্য শরীরচর্চার অভ্যাস রাখতে হবে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ না থাকায় ভালো হবে।
- যেসকল বয়স্ক ব্যাক্তি রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস ভুগছেন, তাদেরকে নিয়মিত চেকআপ করানো উচিত।
- অন্যান্য অসুখ থাকলে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ানো হবে।
উপরোক্ত আলোচনায় শীতে কিভাবে বয়স্কদের পরিচর্যা বা বয়স্কদের সেবা যত্ন করতে হবে সেটা বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। শীতে বয়স্করা নানা অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে শ্বাস প্রশ্বাসজনিত সমস্যা বা শ্বাসনালীর প্রদাহের কারণে তারা কষ্ট পেয়ে থাকে। আবার অনেকের শীতে অ্যাজমা বেড়ে যায়। তাই বয়স্ক ব্যাক্তিদের শীতে বিশেষ যত্নে রাখতে হবে। যাদের বাসায় বয়স্ক ব্যাক্তি রয়েছেন। তাদেরকে সুস্থ রাখার জন্য দায়িত্ব সহকারে তাদের সেবা করা জরুরি।