You are currently viewing স্বাস্থ্য সচেতনতা নিশ্চিতে মরিয়ম খেজুর একটি আদর্শ খাবার 
মরিয়ম খেজুর

স্বাস্থ্য সচেতনতা নিশ্চিতে মরিয়ম খেজুর একটি আদর্শ খাবার 

যদি প্রশ্ন করা হয় মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল কোনটি, তাহলে নি:সন্দেহে এর উত্তরে আসবে খেজুর। এই ফলটি খেতে যেমন  সুস্বাদু তেমনি এর রয়েছে নানা রকম পুষ্টিগুণ। সৌদি আরবের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেজুরের নাম হলো মরিয়ম খেজুর। বাংলাদেশের মানুষেদের কাছেও এই ফল বেশ সুপরিচিত। বিশেষ করে রমজান মাসে প্রতিটি মুসলমানের কাছে মরিয়ম খেজুরের ব্যপকতা লক্ষ্য করা যায়। 

মরিয়ম খেজুরের উৎপত্তি সুদূর সৌদি আরবে শুরু হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও এই খেজুরের চাষাবাদ চলছে। আমাদের আজকের আর্টিকেলে আমরা বিখ্যাত এই মরিয়ম খেজুর এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং এর বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সহ নানা রকম জানা অজানা তথ্য নিয়ে হাজির হয়েছি। বিস্তারিত জানতে পুরো আর্টিকেলটি মন দিয়ে পড়ুন। 

মরিয়ম খেজুর যেভাবে বাংলাদেশে আসলো

মরিয়ম খেজুরের বাংলাদেশে প্রসার লাভের ইতিহাস দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময়। প্রাচীন যুগে আরব বণিকদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে আসা এই ফলটি মুঘল আমলে বিশেষ গুরুত্ব পায়। মুঘল সম্রাটরা এর স্বাদ ও গুণাগুণে মুগ্ধ হয়ে চাষ বাড়াতে উৎসাহ দেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মরিয়ম খেজুরের চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, যা উন্নত জাত উদ্ভাবন ও চাষ পদ্ধতির উন্নয়নে সহায়ক হয়। 

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সরকার কৃষি উন্নয়নের অংশ হিসেবে মরিয়ম খেজুরের চাষ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত রাজশাহী অঞ্চলের অনুকূল মাটি ও জলবায়ু মরিয়ম খেজুরের চাষকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৮০-এর দশক থেকে বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয় এবং ২০০০ সালের পর থেকে রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করে। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নিরন্তর গবেষণা ফলন ও গুণগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার এবং সরকারি উদ্যোগ মরিয়ম খেজুরের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। এভাবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মরিয়ম খেজুর বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্য ও অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

মরিয়ম খেজুরের পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা

শুধুমাত্র স্বাদের জন্য নয় মরিয়ম খেজুর এর পুষ্টিগুণ এবং দারুণ কিছু উপকারিতার জন্যও বেশ জনপ্রিয়। এবার চলুন জেনে আসা যাক মরিয়ম খেজুরের বেশ কিছু পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা সম্পর্কে-

উচ্চ শক্তির উৎস

মরিয়ম খেজুর প্রাকৃতিক শর্করা সমৃদ্ধ, যা শরীরকে দ্রুত শক্তি প্রদান করে। ১০০ গ্রাম মরিয়ম খেজুরে প্রায় ২৭৭ ক্যালরি থাকে, যা দৈনিক শক্তির চাহিদা পূরণে সাহায্য করে।

ফাইবার সমৃদ্ধ

এতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে, যা হজম প্রক্রিয়া সুস্থ রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার

মরিয়ম খেজুরে প্রচুর পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, তামা এবং ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া যায়। এই খনিজগুলি হৃদযন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র এবং হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভিটামিন সমৃদ্ধ

এতে বি-কমপ্লেক্স ভিটামিন যেমন থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন এবং ভিটামিন বি-৬ রয়েছে। এছাড়াও ভিটামিন এ ও কে-এর উপস্থিতি রয়েছে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

মরিয়ম খেজুরে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ক্যারোটিনয়েড, ফেনোলিক অ্যাসিড এবং ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে। এগুলি মুক্ত অণু থেকে শরীরকে রক্ষা করে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

হৃদরোগ প্রতিরোধ

মরিয়ম খেজুরে উচ্চ মাত্রায় পটাসিয়াম এবং কম সোডিয়াম রয়েছে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত মরিয়ম খেজুর সেবন করলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া, এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ধমনীতে কোলেস্টেরল জমা হওয়া রোধ করে, যা আরও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

যদিও মরিয়ম খেজুরে প্রাকৃতিক চিনি রয়েছে, এর উচ্চ ফাইবার সামগ্রী রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। তবে, ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নয়ন

মরিয়ম খেজুরের উচ্চ ফাইবার সামগ্রী পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে, পাচন প্রক্রিয়া সুচারু রাখে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। এছাড়া, এতে থাকা প্রিবায়োটিক উপাদান সুস্থ অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ

মরিয়ম খেজুরে থাকা বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড এবং ফেনোলিক অ্যাসিড শরীরে মুক্ত অণুর ক্ষতিকর প্রভাব কমায়। এই মুক্ত অণুগুলো ক্যান্সার সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত মরিয়ম খেজুর সেবন কোলন ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।

মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা 

বৃদ্ধি: মরিয়ম খেজুরে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এর উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত মরিয়ম খেজুর সেবন স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এবং আলझাইমার্স রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।

হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা

মরিয়ম খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়াম রয়েছে, যা হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। এই খনিজগুলো হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত মরিয়ম খেজুর সেবন বিশেষ উপকারী।

গর্ভাবস্থায় উপকারিতা

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য মরিয়ম খেজুর একটি আদর্শ খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে ফোলেট রয়েছে, যা ভ্রূণের স্বাভাবিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, এর উচ্চ আয়রন সামগ্রী গর্ভকালীন রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। মরিয়ম খেজুরের প্রাকৃতিক শর্করা গর্ভাবস্থায় শক্তির চাহিদা পূরণে সহায়ক।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

মরিয়ম খেজুরে থাকা বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম করে তোলে।

যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন

মরিয়ম খেজুর খাওয়ার সময় যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি, এবার সে সম্পর্কে একটু আইডিয়া নেয়া যাক-

এলার্জি

কিছু ব্যক্তির মরিয়ম খেজুরে এলার্জি থাকতে পারে। যদি কখনও খাওয়ার পর চুলকানি, ফুসকুড়ি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া

মরিয়ম খেজুর কিছু ঔষধের কার্যকারিতা প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা রক্ত পাতলা করার ঔষধ খাচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

পেটের সমস্যা

অতিরিক্ত মরিয়ম খেজুর সেবন পেট ফাঁপা, গ্যাস বা ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। এর উচ্চ ফাইবার সামগ্রী হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে যাদের পাকস্থলী সংবেদনশীল।

খাদ্য মিথস্ক্রিয়া

মরিয়ম খেজুর কিছু খাদ্যের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুধের সাথে একসাথে খেলে তা হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

কোন খেজুরে উপকার বেশি- গুণাগুণ জানলে হতবাক হবেন!

কীটনাশকের অবশেষ

অর্গানিক নয় এমন মরিয়ম খেজুরে কীটনাশকের অবশেষ থাকতে পারে। খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত।

সংরক্ষণকারী পদার্থ

প্রক্রিয়াজাত মরিয়ম খেজুরে সংরক্ষণকারী পদার্থ থাকতে পারে। এগুলো কিছু ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সম্ভব হলে তাজা বা প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষিত মরিয়ম খেজুর খাওয়া উত্তম।

গর্ভাবস্থায় সতর্কতা

যদিও মরিয়ম খেজুর গর্ভবতী মহিলাদের জন্য উপকারী, তবে অতিরিক্ত সেবন রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

শিশুদের ক্ষেত্রে সাবধানতা

ছোট শিশুদের মরিয়ম খেজুর খাওয়ানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে। এর আঁশ শ্বাসনালী বন্ধ করে দিতে পারে। ছোট টুকরো করে বা পেস্ট করে খাওয়ানো নিরাপদ।

সামগ্রিকভাবে, মরিয়ম খেজুর একটি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার। তবে, প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা ও চাহিদা ভিন্ন। তাই, কোনো সন্দেহ থাকলে বা স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে ভালো।

উপসংহার

মরিয়ম খেজুর শুধু একটি সুস্বাদু ফল নয়, এটি বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর পুষ্টিগুণ, ঔষধি বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এটিকে একটি মূল্যবান সম্পদে পরিণত করেছে। মরিয়ম খেজুরের চাষ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করে আমরা শুধু আমাদের খাদ্য তালিকাকেই সমৃদ্ধ করব না, সাথে সাথে দেশের অর্থনীতি ও কৃষকদের জীবনমানও উন্নত করতে পারব। আমাদের উচিত এই দেশীয় সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন ও সংরক্ষণ করা, যাতে আগামী প্রজন্মও এর সুফল ভোগ করতে পারে।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.