আম থেকে তৈরি মিষ্টিজাতীয় মুখোরোচক একটি খাবার হলো আমসত্ব। আমসত্বের কথা আসতেই শৈশবের পুরোনো সেই স্মৃতির কথা মনে পরে যায়। স্কুলের গেটে আচারওয়ালা মামা নিয়ে আসতেন। এছাড়াও অনেকে পাড়া মহল্লা দিয়ে বিক্রি করতেন। গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে আম সকলের প্রিয়। সারা বছর আম পাওয়া যায় না বিধায় আমের মৌসুম শেষ হওয়ার পরে আমের স্বাদ বছরজুড়ে ধরে রাখতে তৈরি করা হয় আমসত্ব।
অঞ্চল ভেদে আমসত্বকে আমতা, আমসি নামে ডাকা হয়। আবার এটি ম্যাংগোবার নামেও পরিচিত। এটি ভারতের পশ্চিবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাঙালীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এটি কাচা ও পাকা দুই ধরনের আম দিয়ে তৈরি করা যায়। আমসত্বের উল্লেখ বাংলা সাহিত্যে বহুবার পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় এসেছে “আমসত্ব দুধে ফেলি, তাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে। হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিঃস্তব্ধ, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।”
আমসত্ত্ব খাওয়ার উপকারিতা
আমের উপকারিতা কমবেশি সকলেই জানি আমরা। আম দিয়ে তৈরি আমসত্বের রয়েছে অনেক উপকারিতা তা হয়তো অনেকের অজানা। সাধারণত প্রতি ১০০ গ্রাম আমে প্রায় ১৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি রয়েছে। এতে বিটা ক্যারোটিন বিদ্যমান। প্রায় ১০০ গ্রাম পাকা আমে প্রায় ১৯৯০ মাইক্রোগাম বিটাক্যারোটিন থাকে। আজকে আমরা এর উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
আমসত্বতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা ক্ষতিকর (এলএলডি) কোলেস্টেরল কমিয়ে, উপকারি (এইচএলডি) কোলেস্টেরল বাড়িয়ে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
আমসত্বতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
হজমে উন্নতি
বর্তমানে অনিয়মতান্ত্রিক জীপনযাবনের জন্য কম বেশি সকলের হজমের সমস্যা রয়েছে। পেটের রোগ বা বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে আমসত্ব বেশ উপকারি। এটি খাওয়ার ফলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
আমসত্বে সাইট্রিক অ্যাসিড, টারটারিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড রয়েছে। এছাড়াও ভিটামিন সি রয়েছে। যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে রোগ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী হওয়ার ফলে সহজে শরীরের রোগ বাসা বাধতে পারেনা।
সর্দি কাশি
সবচেয়ে কমন একটি রোগ হলো সর্দি কাশি যা বাতাসের সাহায্যে খুব সহজে আমাদের শরীরের প্রবেশ করে। শিশু ও বয়স্করা এই সমস্যায় বেশি ভুগতে থাকেন। আমসত্ব সর্দি কাশি দূর করতে সাহায্য করে।
স্কার্ভি প্রতিরোধ
আমসত্বে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। এটি স্কার্ভি নামক রোগ দূর করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ ভিটামিন সি এর অভাব দূর করে।
হাড় মজবুত করতে
আমসত্ব থাকা ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও গর্ভবতী মায়েদের ক্যালসিয়াম সমস্যা দূর করে থাকে।
রুচি বৃদ্ধি করতে
খাবারের রুচি বৃদ্ধি করতে আমসত্ব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। যাদের অরুচি রয়েছে তারা আমসত্বটি খেতে পারেন।
দেশে আমসত্বের জনপ্রিয়তা
কাচা আম বা পাকা আম দিয়ে তৈরি করা যায় মজাদার আমসত্ব। টক মিষ্টি বা টক ঝাল মিষ্টি আমসত্ব এই দুই স্বাদের বানানো হয়ে থাকে। ভারতে এর কদরের পাশাপাশি আমাদের দেশেও আমসত্বের কদর বেড়েই চলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য সুপরিচিত। বর্তমানে আমসত্ব সারাদেশে জনপ্রিয়তা কুড়াচ্ছে। এজন্য আমসত্বের কারিগররা এটি তৈরি করতে ব্যস্ততায় সময় পার করছেন। রাজশাহী অঞ্চলগুলোতেও নারীরা আম সংগ্রহ করে আমসত্ব তৈরি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন।
আমসত্ব তৈরির রেসিপি
আমসত্ব ছোট বড় আমরা সকলেই পছন্দ করে থাকি। আমের সিজনে আচারের পাশাপাশি আমসত্ব অনেকে বাড়িতে তৈরি করে থাকেন। আবার অনেকে ঘরে তৈরি করার সময় পান না। তারা বাহিরে থেকে কিনে থাকেন। যদি বাহিরের কেনা আমসত্ব আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। এখন তো বাজারেও কাচা পাকা আম কিনতে পাওয়া যায়। তাই একটু সময় নিয়ে ঘরোয়াভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করে নিতে পারেন আমসত্ব। যদিও এটি অনেক পদ্ধতিতেই তৈরি করা যায়। ট্রেডিশনাল আমসত্বের মতো করে কিভাবে আমসত্ব তৈরি করা যায় সেই রেসিপিটি জেনে নেওয়া যাক-
টক ঝাল মিষ্টি আমসত্ব রেসিপি
উপকরণ
- কাচা আম ১ কেজি
- হলুদ গুড়ো হাফ চা চামচ
- মরিচের গুড়ো ১ চা চামচ
- বিটলবন ১ চা চামচ
- পাঁচফোড়ন ১ চা চামচ
- চিনি ৩ টেবিল চামচ
- লবন স্বাদমতো
প্রস্তুতপ্রণালী
প্রথমে আমগুলো ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। তারপরে আমের মাথার দিকটা কিছুটা কেটে ফেলে দিতে হবে। চুলায় একটি পাত্র বসিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দিয়ে আমগুলো সিদ্ধ করে নিতে হবে। সিদ্ধ হয়েছে কিনা সেটা একটি চামচের সাহায্যে চেক করে নেওয়া যেতে পারে। অথবা এটি দেখলেই বোঝা যাবে। এরপরে একটু ঠান্ডা করে উপরের খোসাটা ছাড়িয়ে নিতে হবে। এবং ভিতরের আঁটি বা বীজটাকে ফেলে দিতে হবে। ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে বা হাত দিয়ে ভালোভাবে চটকিয়ে নিতে হবে।
ব্লেন্ড করা হয়ে গেলে অন্য একটি পাত্রে নিয়ে এরমধ্যে হলুৃদ, মরিচের গুড়া, বিটলবন, লবন, পাঁচফোড়ন, চিনি দিয়ে সবগুলো মিশিয়ে নিতে হবে। এরপরে কিছুক্ষণের জন্য জ্বাল করে নিতে হবে। জ্বাল করার সময় খেয়াল রাখতে হবে পাত্রের তলায় লেগে না যায়। তারপরে শুকনো মরিচ (আগে থেকে ভেজে টেলে নেওয়া) দিতে হবে। আরও কিছুক্ষণ জ্বাল দিতে হবে। আমের পানি পানি ভাবটি শুকিয়ে আমসত্ব আঠালো হয়ে এলে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে।
আমসত্ব সেট করার জন্য একটি ট্রে নিতে হবে। কেউ চাইলে বড় প্লেট নিতে পারেন। এর ওপরে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার দিয়ে বা শুধু তেল ব্রাশ করে নিতে হবে। এবার একটু করে আমসত্ব চামচের সাহায্যে ট্রেতে লেয়ার করে দিতে হবে। কেউ যদি আমসত্ব মোটা খেতে পছন্দ করেন তাহলে বেশি লেয়ার করে নিতে পারেন। মিডিয়াম আমসত্বর জন্য ৩টি লেয়ার দিলেই হবে।
প্রথম লেয়ারটি শুকিয়ে নিতে হবে। চুলা জালিয়ে এরপাশে আমসত্বের ট্রে রেখে দিতে হবে। শুকানোর সময় নির্ভর করবে তাপমাত্রার ওপর। রোদে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে রোদে দিয়েও শুকিয়ে নেওয়া যাবে। চুলা বা রোদের কোনো ব্যবস্থা না থাকলে ওভেনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় শুকিয়ে নিতে পারবেন।
একটি লেয়ার শুকানো হয়ে গেলে তার ওপরে দ্বিতীয় লেয়ারটি দিয়ে আগের মতো শুকিয়ে নিতে হবে। বাকী আমসত্ব ঢেকে নরমাল ফ্রিজে ঢেকে রেখে দিতে হবে। দ্বিতীয় লেয়ারের পরে তৃতীয় লেয়ার দিতে হবে। আমসত্ব তৈরি হয়ে গেলে পছন্দ অনুযায়ী সেইপ করে কেটে নিতে পারেন। কাচা আম দিয়ে তৈরি আমসত্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি কিছু কালচে দেখতে যেমনটি আমরা বাহিরে কিনতে পাই। এর স্বাদ কিছুটা টক।
আমসত্ব পরিবেশন
- আমসত্ব শুধু এমনিতেই খাওয়া যায়।
- গরম ভাতের সাথেও অনেকে খেয়ে থাকেন।
- এছাড়াও খিচুড়ী ও পোলাও দিয়ে খাওয়া যায়।
- আমসত্বের মসলা ও সরিষার তেল মুড়ি মাখাতে ব্যবহার করা খাওয়া যেতে পারে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
- আমসত্ব তৈরি করে সংরক্ষনের জন্য পরিষ্কার কাচের বোয়ামে রাখতে হবে।
- ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করতে হবে।
- ঠান্ডা ও শুষ্কা জায়গায় আমসত্বের বোয়ামটি রাখতে হবে।
- ফ্রিজে রেখেও সারা বছর সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
- আমসত্ব নিয়মিত খাওয়ার জন্য অন্য একটি বোয়ামে আলাদা করে রেখে দিতে হবে। এতে বার বার একই বোয়াম খুলতে হবেনা।
- মাঝে মাঝে হালকা রোদে দিতে হবে।
- পানির স্পর্শ যেনো না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ পানি লাগলে আমসত্বের মধ্যে দ্রুত ফাংগাস লেগে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- আমসত্ব বোয়াম থেকে তুলার জন্য শুকনো পরিষ্কার চামচ ব্যবহার করতে হবে। চামচে যেনো পানি লেগে না থাকে নিশ্চিত হতে হবে।
- আমসত্ব প্লাস্টিকের বোয়ামে রাখা যাবে না। এতে ছত্রাক পরে তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- আমসত্বতে ভিনেগার ব্যবহার করলেও বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়। যদিও ভিনেগার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
- আমসত্বতে সরিষার তেল বেশি পরিমানে ব্যবহার করতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনায় আমসত্ত্ব খাওয়ার উপকারিতা, তৈরির পদ্ধতি, সংরক্ষণের নিয়ম ও কিভাবে পরিবেশন করা যায় এই সম্পর্কে বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আমাদের দেশের এর জনপ্রিয়তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। লেখাটি পড়ে, ট্রেডিশনাল আমসত্বের মতো করে আপনিও ঘরোয়াভাবে তৈরি করে বছর জুরে এর স্বাদ নিতে পারবেন।