You are currently viewing ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলের উপকারিতা,  পুষ্টি ও গুনগত মান
ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলের উপকারিতা

ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলের উপকারিতা,  পুষ্টি ও গুনগত মান

সরিষার তেল শুধু এর সুঘ্রান এবং ঝাঁজের জন্যই সেরা তা কিন্তু না বরং এই তেলের রয়েছে নানা স্বাস্থ্য উপকারিতা। প্রবাদে একটি কথা রয়েছে “সরিষার তেল নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও”। এই কথা দ্বারা নিশ্চিন্ত থাকা বা চিন্তামুক্ত থাকাকে বোঝানো হয়ে থাকে। যখন ই দেখবেন কেউ অধিক দুশ্চিন্তা করছেন তখন তাকে এই কথাটি বলা হয় স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। আমরা অনেকেই শুধু সরিষার তেল রান্নার কাজে ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু প্রাচীন কাল থেকেই গ্রামাঞ্চলে সরিষার তেল রান্নার পাশাপাশি চুলে এবং শরীরে ব্যবহার করা হয়। 

ঘানি ভাঙ্গা তেল এর গুনগত মান 

সরিষার তেলের বর্তমানে দুইটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। ঘানি ভাঙ্গা তেল এবং মেশিনের মাধ্যমে ভাঙ্গানো তেল। ঘানি ভাঙ্গা পদ্ধতিতে তেল তৈরি করতে বেশ সময় লাগে অন্যদিকে মেশিনে তেল ভাঙ্গানো হলে কম সময়ে অধিক পরিমানে তেল পাওয়া যায়। তাই বাজারে মেশীনের ভাঙ্গানো তেলের আধিক্য টাই বেশি। অথচ সবচেয়ে সেরা মানের তেল পাওয়া যায় ঘানি ভাঙ্গা পদ্ধতিতে। কারন মেশীনে তেল তৈরি করার সময় এতে প্রচুর তাপ ব্যবহার করা হয়।

অন্যদিকে ঘানি ভাঙ্গা পদ্ধতিতে এখানে কোন বাহ্যিক তাপের ব্যবহার করা হয়। অধিক তাপে তেলের পুষ্টিগুন নষ্ট হয়। কিন্তু কোনো তাপ ছাড়াই যখন তেল তৈরি করা তখন সেটিকে কোল্ড প্রেসড পদ্ধতি বলা হয়। এই কোল্ড প্রেসড পদ্ধতিতে তৈরি তেলের গুনগত মান অন্য যেকোনো তেল থেকে বেশি। তাই বলা যায় ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল হলো গুনেমানে সেরা। 

সরিষার তেলের পুষ্টি উপাদান

সরিষার তেলের পুষ্টি উপাদান 

প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষার তেলে রয়েছে ৮৮৪ ক্যালরি খাদ্যশক্তি এবং এটি ১০০% চর্বি। এই চর্বি তে রয়েছে – 

  • স্যাচুরেটেড ফ্যাট-১১%
  • মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট-৫৯%
  • পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট-২১%  

এছাড়া সরিষার তেলে আরও রয়েছে প্রোটিন, ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন ই, বিটা ক্যারেটিন এবং সামান্য পরিমানে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড।  

সরিষার তেলের উপকারিতা

সরিষার তেলের ব্যবহার কিন্তু শুধু রান্নাতে না। সরিষার তেলের বহুবিধ গুনাবলির কারনে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে চিকিৎসা তে এটি প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। সাধারনত আমরা আচার, খিচুরি, ভর্তা ইত্যাদি আইটেমে সরিষার তেল ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু যারা সরিষার তেলের গুনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন, তারা কিন্তু নিয়মিত এই সরিষার তেল ব্যবহার করে আসছেন। চলুন তাহলে সরিষার তেলের বিশেষ কিছু গুনাবলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। 

রান্নার স্বাদ বৃদ্ধি করে 

সরিষার তেলে খাবার রান্না করলে একদিকে যেমন স্বাদ বৃদ্ধি পায় ঠিক সেই সাথে সরিষার তেলের রান্না অনেক স্বাস্থ্যকর। সাধারন সয়াবিন কিংবা পাম ওয়েল রান্নায় ব্যবহার না করে সরিষার তেলে রান্না করে দেখবেন, এটি রান্নার টেষ্ট বাড়াবে। 

বাংলাদেশে সরিষার তেলের দাম এবং দাম বৃদ্ধির কারণ

হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে 

সরিষার তেলে আমাদের শরীরের হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত সরিষার তেল খেলে এটি আপনার হজম প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখবে। 

ওজন কমাতে সাহায্য করে 

সরিষার তেলে রয়েছে রিবোফ্ল্যাভিন (Riboflavin) ও নায়াসিন (Niacin)। যা আমাদের শরিরে মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে এটি ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখে। 

কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায় 

সরিষার তেলে থাকা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরে কোলেস্টেরন এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তাই নির্দিষ্ট পরিমানে সরিষার তেল খেলে এটি হার্ট ভালো রাখে। 

উদ্দিপক হিসেবে কাজ করে 

পরিপাক তন্ত্র, রেচন তন্ত্র এবং রক্ত সংবহন তন্ত্রের শক্তিশালি উদ্দিপক হিসেবে সরিষার তেল বেশ কার্যকরি ভুমিকা পালন করে। শরীরে সরিষার তেল ব্যবহার করলে এটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে থাকে, ফলে এটি শরীরের পেশিগুলোকে সবল এবং উজ্বীবিত রাখে। 

সরিষার তেলের উপকারিতা

খাবারের রুচি বাড়ায় 

সরিষার তেলের তৈরি ভর্তা কিংবা আচার আমাদের খুব পছন্দের খাবার। সরিষার তেল আমাদের পরিপাক তন্ত্রে ক্ষুধার সৃষ্টি করে। ফলে খাবারের রুচি বাড়ে। 

ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে  

সরিষার তেলে রয়েছে গ্লুকোসিনোলেট নামক ক্যানসার বিরোধী উপাদান, যা ক্যানসার জনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে এবং মলাশয় ক্যান্সার ও অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও সরিষার তেল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে।  

ঠান্ডার সমস্যা দূর করে 

শীতকালে আমরা অনেকেই ঠান্ডা কাশির সমস্যায় ভুগে থাকি। সরিষার তেল আমাদের শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। আর ঠান্ডা কাশি কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার আক্রমন থেকেই হয়েই থাকে। তাই ঠান্ডা কাশির সমস্যা দূর করতে সরিষার তেল অনেক উপকারি। 

ব্যথা কমাতে সহায়ক 

প্রাচীন কাল থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে সরিষার তেলের ব্যবহার রয়েছে। সরিষার তেলে রয়েছে প্রদাহ বিরোধি উপাদান যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। হাটুর ব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের ব্যথা, বাতের ব্যথা ইত্যাদি কমাতে সরিষার তেল অনেক উপকারি।  

ফুসফুস পরিষ্কার রাখে 

সরিষার তেলকে বলা হয় শ্বাসতন্ত্র পরিষ্কারক। সরিষার তেল এবং রসুন একসাথে গরম করে বুকে ও পিঠে মালিশ করলে এটি কফ পরিষ্কার করে এবং ফুসফুসকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। 

এজমা কমাতে সাহায্য করে 

হুট করেই এজমা অ্যাটাক হলে সেক্ষেত্রে তার বুকে ও পিঠে সরিষার তেল মালিশ করে দিলে রোগির শ্বাস নেবার ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং সে কিছুটা আরাম বোধ করে।  

স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে  

সরিষার তেল স্বরনশক্তি বাড়াতে এবং চেতনা উন্নয়নে সাহায্য করে। 

মাসিকের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে  

মাসিকের ব্যথার সমস্যা অনেক মেয়েদের রয়েছে। সরিষার তেল যেহেতু ব্যথা উপশম করে। তাই মাসিকের ব্যথার জন্য পেটে হালকা গরম তেল মালিশ করতে এটি ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে। 

মশা ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে 

সরিষার তেলের নিজস্ব একটা ঘ্রান রয়েছে এবং রয়েছে কড়া ঝাঁজ। সরিষার তেলের এই ঝাঁজ এবং গন্ধ পোকামাকড় তাড়াতে সাহায্য করে। 

মাইগ্রেনের সমস্য কমায় 

সরিষার তেলে রয়েছে খনিজ উপাদান ম্যাগনেসিয়াম। ম্যাগনেসিয়াম মাইগ্রেনের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। তাই সরিষার তেলে তৈরি রান্না খেলে এটি ধিরে ধিরে আপনার মাইগ্রেনের সমস্যা দূর করবে।  

চুলের যত্নে সরিষার তেল  

খাটি সরিষার তেলে থাকা ভিটামিন মিনারেল, ম্যাগনেসিয়াম, বিটা ক্যারেটিন , অ্যান্টিওক্সিডেন্ট ইত্যাদি চুলের জন্য বেশ উপকারি। চলুন কিছু উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। 

চুল লম্বা করতে সাহায্য করে 

সরিষার তেলে রয়েছে ভিটামিন, বিটা ক্যারেটিন, সেলেনিয়াম যা দ্রুত চুল লম্বা করতে সাহায্য করে। 

চুল পড়া কমায়

সরিষা তেল আমাদের শরীরে উদ্দিপক হিসেবে কাজ করে। সপ্তাহে অন্তত ২ দিন সরিষার তেল মাথায় ম্যাসাজ করতে এটি মাথার স্কাল্পে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করবে। ফলে দ্রুত চুল পরার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। 

খুশকি কমাতে সাহায্য করে 

সরিষার তেলে রইয়েছে এন্টিফাংগাল এবং এন্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। তাই চুলে সরিষার তেলের ব্যবহার খুশকি কমাতে সাহায্য করবে। 

চুল পাকার হাত থেকে রক্ষা করে 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে থাকে। এই যেমন ধরুন বৃদ্ধ বয়েসে চুল পাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বয়সের আগেই যদি আপনার চুলে পাক ধরে বুঝতে হবে আপনার মাথার স্কাল্পের কোষগুলো রঞ্জক পর্দার্থ তৈরি করা বন্ধ করেছে। সাধারনত শরীরে যখন ভিটামিন বি -১২ এর  অভাব হয় তখন এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চুলে সরিষার তেল ব্যবহার করতে পারেন। এটি চুলকে ঘন এবং কালো রাখতে সাহায্য করবে। 

চুলকে মসৃন রাখে 

সরিষার তেল চুলকে মসৃন রাখতে সাহায্য করে। সপ্তাহে ১ দিন মাথায় সরিষার তেল ও মেহেদি গুড়া ও মেথি গুড়া মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এটি চুলকে মসৃন ও উজ্বল রাখতে সাহায্য করবে। 

ত্বকের যত্নে সরিষার তেলের উপকারিতা 

ত্বকের যত্নে সরিষার তেলের উপকারিতা   

চুলের মতো ত্বকের যত্নেও সরিষার তেল বেশ উপকারি। চলুন কিছু উপকারিতা জেনে নেওয়া যাক। 

ত্বক পরিষ্কার রাখতে 

ত্বক পরিষ্কার রাখতে সরিষার তেল অনেক উপকারি। এটিকে প্রাকৃতিক ক্লিনজার ও বলা হয়ে থাকে। কারন সরিষার তেলে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড। খাটি সরিষার তেল কে আমরা ত্বক পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি। বিশেষ করে মেকআপ রিমুভ করার জন্য তুলা তে সামান্য সরিষার তেল লাগিয়ে ত্বকে ব্যবহার করলে দেখবেন সমস্ত মেকআপ সুন্দর ভাবে পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

ব্রন বা পিম্পল কমাতে

সরিষার তেলে থাকা এন্টিব্যাকটেরিয়াল এবং এন্টিফাংগাল উপাদান ব্রন কমাতে সাহায্য করে। 

দাগ কমাতে 

আমাদের ত্বকে অনেক সময় ছোট ছোট দাগ তৈরি হয়, আবার অনেক সময় ত্বকে অনেক পিগমেন্টেশন এর সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে বেসন, টক দই এবং সামান্য সরিষার তেল মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করলে এটি মুখের দাগ কমাতে সাহায্য করবে। 

ত্বকের বলিরেখা দূর করতে 

ত্বকের বলিরেখা দূর করার জন্য হালকা ভাবে ত্বকে সরিষার তেল ম্যাসেজ করতে পারেন। ৫ মিনিট পর ক্লিনজার দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে ফেলবেন। 

ঠোট ফাটা রোধ করে

শীতকালে ঠোট ফাটা সমস্যা তে ভুগছেন? তাহলে বাজার থেকে নামি দামি লিপবাম ব্যবহার না করে একবার সরিষার তেলের ব্যবহার করে দেখুন। রাতে ঘুমানোর আগে নাভিতে অল্প পরিমানে সরিষার তেল মালিশ করে ঘুমান। এটি আপনাকে ঠোট ফাটা রোধ করবে এবং ঠোটকে মোলায়েম রাখবে। 

প্রাকৃতিক সিরাম 

ত্বকের যত্নে আমরা অনেকেই সিরাম ব্যবহার করে থাকি। তবে সরিষার তেল আমাদের ত্বকে প্রাকৃতিক সিরাম হিসেবে কাজ করে। এটি ত্বকের উজ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে। 

সরিষার তেলের অপকারিতা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি

সরিষার তেলের সতর্কতা 

  • সরিষার তেল আমাদের শরীর এবং ত্বকের জন্য অনেক উপকারি হলেও সরিষার তেলের ব্যবহারের সময় অবশ্যই খাটি তেল নির্বাচন করতে হবে। 
  • কোনো খাবারেই অধিক পরিমানে তেল ব্যবহার করা যাবে না।
  • মাথায় সরিষার তেল ব্যবহার করার পর অবশ্যই শ্যাম্পু দিয়ে ভালো ভাবে চুল ধুয়ে নিতে হবে। 
  • তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারিদের সরিষার তেল ব্যবহার না করাটাই উত্তম।
  • ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহারের সময় অবশ্যই প্যাচ টেষ্ট করে নিবেন। এই তেলটিতে আপনার এলার্জি আছে কিনা বা তেলটি আপনাকে সুট করছে কিনা এটা অবশ্যই চেক করবেন।


উপরোক্ত আলোচনায় সরিষার তেলের উপকারিতা, ব্যবহারের নিয়ম, পুষ্টিগুণ ও সর্তকর্তা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি আজকের লেখাটি পড়ার পরে অনেক উপকৃত হবেন। এবং নিত্যদিনের সঙ্গি হিসেবে বেছে নিতে পারেন সরিষার তেল। ফলে আপনি পেয়ে যাবেন বহুগুণ উপকারিতা। 

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.