গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে সরিষার তেল। এটি যেমন আমাদের দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজনীয় তেমনি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই ।
এছাড়া মুড়ি মাখা, বিভিন্ন পদের ভর্তা তৈরিতে সরিষার তেল ছাড়া যেন চলেই না। সরিষার তেলকে আবার সর্ষের তেলও বলা হয়। বর্তমানে কোল্ড প্রেস সরিষার তেলের ব্যবহার কমে যাচ্ছে, তবুও যারা এই তেলের গুণগত মান সম্পর্কে অবগত, তারা প্রতিনিয়ত কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলের ব্যবহার করছেন। আমাদের আজকের লেখায় কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল কি এবং এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জানবো।
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল কি?
কোল্ড প্রেস সরিষার তেল বলতে যে প্রক্রিয়ায় কোনো উচ্চ তাপ বা রাসায়নিক ব্যবহার না করে ঐতিহ্যবাহী ঘানি ব্যবহার করে সবিষার বীজ থেকে চাপের মাধ্যমে তেল নিষ্কাশন করা হয়। একে আবার ঘানি ভাঙা সরিষার তেলও বলা। ফলে তেলের স্বাদ, ঘ্রাণ ও পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। এই তেলকে ভেষজ প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়েটিক বলা হয়।
বাজারে তিন ধরনের সরিষার দানা পাওয়া যায়-
- দেশি মাঘী সরিষা।
- শ্বেতি সরিষা।
- রাই সরিষা।
সবচেয়ে ভালো সরিষার বীজ হলো মাঘী সরিষা ।
সয়াবিন নাকি সরিয়ার তেল কোনটি ভালো?
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলের উপকারিতা
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে, যা অ্যান্টি-কারসিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই এটি ক্যান্সারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে অর্থাৎ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে বেশ কার্যকর ।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল ব্যবহারে শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়, যা হৃদরোগের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। সাথে আমাদের শরীরের হার্টকে ভালো রাখে।
প্রাকৃতিক সান্সক্রিম
সরিষার তেলে ভিটামিন ই থাকে। যা আমাদের ত্বকে বয়সের ছাপ ও বলিরেখা দূর করে। এছাড়াও সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে ত্বককে সুরক্ষা করে । ফলে একে প্রাকৃতিক সান্সক্রিম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ব্যবহারের সময় সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে যাতে তেল চিটচিটে না লাগে । অন্যথায় ধুলোবালি ত্বকে জমে তা থেকে ত্বকের সমস্যা হতে পারে ।
রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল শরীরে নিয়মিত ব্যবহারের ফলে রক্ত চলাচল বাড়াতে সাহায্য করে । ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না । আমাদের শরীর থাকে সুস্থ ।
শরীরের ব্যথা কমায়
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলে খনিজ উপাদান রয়েছে। যা আমাদের শরীরের মাংস পেশির সঞ্চালন করে ও হাড়ের গঠন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।সেই সাথে শরীরের কোনো অংশে ব্যথা হলে সাধারণত সরিষার তেল মালিশ করা হয়ে থাকে। ফলে ব্যথা অধিকাংশ করে যায়।
ঠান্ডা দূর করে
ঠান্ডার মধ্যে সর্দি কাশির সমস্যা অনেকের হয়। এই সমস্যা দূর করতে সরিষার তেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যখন বুকে প্রয়োগ বা তার দৃঢ় সুবাস নিশ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া হয়, এটা শ্বাসযন্ত্রের নালির থেকে কফ অপসারণেও সাহায্য করে।
মাইগ্রেশনের ব্যথা কমাতে
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল নিয়মিত খেলে এবং ত্বকে ব্যবহার করলে মাইগ্রেনের সমস্যা উপশম করে।
চুলের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলে পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন, মিনারেল চুলের অকালপক্বতা রোধ করে থাকে। এছাড়াও চুলকে রুক্ষতার হাত থেকে রক্ষা, চুলের উজ্জ্বলতা ও মজবুত করতে সাহায্য করে ।
ঠোঁট ফাটা রোধ করে
ঠোঁট ফাটা রোধ করতে ও ঠোঁট নরম কোমল রাখতে প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে সরিষার তেল।
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলের নানা ব্যবহার
প্রাচীন কাল থেকেই সরিষার তেলের ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে । এবার আমরা কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো
- স্বাস্থ্যকরঃ এই তেল স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। নিয়মিত খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরের হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে। পাশাপাশি দেহকে রাখে সতেজ ।
- স্বাদ বৃদ্ধিঃ বিভিন্ন রান্নায় কোল্ড প্রেস সরিষার তেল খাবারের স্বাদকে বাড়িয়ে তোলে।
- ত্বকের যত্নেঃ এটি শরীরে ব্যবহার করার ফলে ত্বককে সুস্থ রাখে।
- চুলের যত্নেঃ চুল পড়া বন্ধ, চুল কালো ও বৃদ্ধি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এই তেল।
রান্নায় সরিষার তেলের যে সকল ব্যবহার
- বিভিন্ন ধরনের সবজি ভাজিতে ব্যবহার করা যায়।
- হরেক পদের ভর্তা বানাতে৷ যেমন ইলিশের লেজ ভর্তা, আলু ভর্তা, বাদাম ভর্তা ইত্যাদি।
- মুড়ি মাখাতেও ব্যবহার করা হয় এই তেল।
- মাংস রান্নায় সরিষার তেল।
- বিরিয়ানি, তেহারীতেও ব্যবহার করা হয়।
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল উৎপাদন পদ্ধতি
সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয় কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল । অর্থাৎ সকল ধরনের শক্তিশালী কাঠ দিয়েই ঘানি তৈরি করা যেতে পারে। তবে তেঁতুল কাঠের তৈরি ঘানি থেকেই সবচেয়ে বেশি উৎকৃষ্টমানের তেল পাওয়া যায়।
বতর্মানে সরিষার তেল দুইটি পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয় যথা-
- যান্ত্রিক ঘানিঃ এতে চাপ কম দিয়ে সরিষার দানা ভাঙা হয় । এতে উৎকৃষ্টমানের সরিষার তেল পাওয়া যায় । কারণ যত কম হিট হবে তত পুষ্টিগুণ বজায় থাকবে।
- স্পিনারঃ স্পিনার মেশিনে ২য় চাপের মাধ্যমে সরিষার বীজ ভাঙা হলে প্রচণ্ড গরমে তেল পুড়ে যায়। ফলে তেলের গুণগত মান অনেক কমে যায়।
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলের পুষ্টিগুণ
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেলের পুষ্টি বহুগুণ। চলুন জেনে আসা যাক-
কোল্ড প্রেস সরিষার তেলে ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড,ভিটামিন-এ, ই, কে, বিটা ক্যারেটিন, ক্যালসিয়াম,আলফা এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে থাকা অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল নামের উপাদান রয়েছে যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
ফলিক, লিনোলিক ফ্যাটি অ্যাসিড চুলের যত্নে সাহায্য করে। এছাড়াও মনোস্যাচুটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে। এবং প্রতি ১০০ গ্রামে স্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রায় ১২ মিঃ গ্রাম , পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রায় ৫৯ মিঃ গ্রাম থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষার তলে ৮৮৪ ক্যালরি থাকে। প্রতি ১ চা চামচ সরিষার তেলে ১২৬ ক্যালরি থাকে। সরিষার তেলে থায়ামিন , রিবোফ্লাভিন , নিয়াসিন, ফোলেট, পাইরিডক্সিনও পলিকুইননের মতো ভিটামিন রয়েছে।
সরিষার তেলের স্মোক পয়েন্ট
একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর তেলের স্মোক পয়েন্ট থেকে নীলাভ ধোঁয়া বের হয়, পরবর্তীতে সরিষার তেলে থাকা চর্বি ভেঙ্গে অক্সিডাইজ হয়, ফলে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল উৎপাদিত হয়। ফ্রি র্যাডিক্যাল শরীরে অক্সিডেটিস স্ট্রেস সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে তেলের স্মোক পয়েন্ট বেশি, সেটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশি নিরাপদ। সকল প্রকার ভোজ্য তেলের মধ্যে সরিষার তেলের স্মোক পয়েন্ট সব থেকে বেশি । অর্থাৎ সরিষার তেলের স্মোক পয়েন্ট সর্বোচ্চ ২৫০ ।
খাঁটি সরিষার তেল চেনার উপায়
চারিদিকে সবকিছুতেই ভেজালের ছড়াছড়ি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিজ স্বার্থে সরিষার তেলে ভেজাল মিশ্রিত করছেন। এতে সাধারণ মানুষজন ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে পরছেন। তাই ভেজাল এড়িয়ে চলতে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নে খাঁটি সরিষার তেল চেনার কিছু সহজ উপায় জেনে আসা যাক-
- আসল সরিষার তেলের মধ্যে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে। যা চোখে পানি এনে দেয়। অপরদিকে ভেজাল মিশ্রিত সরিষার তেলের গন্ধ খুব বেশি তীব্র হয় না ।
- সরিষার তেলের রং খুব গাঢ় হয়, তেলে হালকা হলুদ রং দেখলে সেটা ভেজাল হতে পারে।
- সরিষার তেল কিনে এনে ২-৩ ঘণ্টা রেফ্রিজেরেটরে রেখে দিন। এরপর ফ্রিজ থেকে বের করে দেখুন। যদি তেলের খানিকটা জমে সাদা হয়ে যায় তাহলে বুঝবেন সেই তেলে ভেজাল মেশানো হয়েছে। কারণ খাঁটি সরিষের তেল কখনো জমে না, সবসময় তরল অবস্থায় থাকে।
- সহজ ঘরোয়া উপায় হলো হাতের তালুতে আঙুল দিয়ে ঘষে দেখা। আপনার হাতের তালুতে একটুখানি সরিষের তেল নিয়ে তারপর তা খানিকক্ষণ ঘষে নিন। যদি তেলের রং ছেড়ে যেতে শুরু করে, কোনোও আলাদা গন্ধ পান বা চিটচিটে ভাব অনুভব করেন তবে বুঝে নেবেন সেই তেল ভেজালমিশ্রিত।
বিভিন্ন প্রকার তেলের পরিচিতি, তেল কত প্রকার ও কি কি?
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল ব্যবহারে সতর্কতা
রান্নার সময় তেল গরম হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করে থাকি। এরপরে ধোঁয়া উঠলে চুলার আঁচ কমিয়ে ঠান্ডা হতে দেই। এর ফলে তেলের সকল পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই এটি উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যবহার করা উচিত নয়।
উপরিউক্ত আলোচনায় খাঁটি সরিষার তেল চেনার উপায়, কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল কি, ব্যবহারবিধি ও উপকারিতা ইত্তাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।