সুন্দরবনের মধু দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। স্বাদ এবং ঘ্রাণের কারণে এই মধু অন্যান্য মধুর থেকে আলাদা হয়। যে কারণে মানুষ এই মধু খেতে বেশি পছন্দ করে। তাছাড়া পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে সুন্দরবনের মিশ্র ফুলের মধু সব থেকে এগিয়ে। সাধারণত যে কোন মধু কেনার আগে আমাদের অনেক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হয়।
বিশেষ করে সুন্দরবনের মধুর বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখতে হয় নাহলে সহজেই ভেজাল মধুর খপ্পরে পরতে হয়। আমাদের আজকের লেখায় আমরা সুন্দরবনের মধুর বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা এবং সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সুন্দরবনের মধুর বৈশিষ্ট্য
সুন্দরবনের মধু দেশের সব থেকে দামি ও বিখ্যাত মধুর মধ্যে সব থেকে উৎকৃষ্ট। পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন হরেক রকম গাছের সমাহার। এখানে অনেক ধরনের জানা অজানা উদ্ভিদ জন্মায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে জুন মাস পর্যন্ত সুন্দরবনে নানান ধরনের ফুল জন্মায়।
এই ফুল গুলো থেকে নেকটার নিয়ে মৌমাছিরা চাক তৈরি করে। সেই চাক থেকে সংগ্রহ করা মধু সারাদেশের সব থেকে উৎকৃষ্ট মানের মধু হিসেবে বিবেচিত হয়। সাধারণত সুন্দরবনে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত মধুর সিজন চলে। এই সময় মধু সংগ্রহ করার জন্য মধু সংগ্রাহক গণ দল বেঁধে বনের ভেতরে যায়।
সাধারণত সুন্দরবনে যে সকল ফুলের মধু পাওয়া যায় তাদের মধ্যে খলিশা, গড়ান, কেওড়া ও বাইন গাছের ফুল প্রধান। সুন্দরবনের মধু বলতে আমরা এই চারটি ফুলের মধুর কথা বলে থাকি। তো মধুর সিজন চলাকালীন চাক থেকে যে মধু সংগ্রহ করা হয় তাতে এই চারটি ফুলের নির্যাস, স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে।
এই কারণে সুন্দরবনের মধুর স্বাদ সব জায়গায় একই রকম হয় না। যে কারণে এই বিষয়ে সচেতন না হলে সহজেই ধোঁকা খেতে হয় এবং ভেজাল মধুর খপ্পরে পরতে হয়। নিচে সুন্দরবনের খাঁটি মধুর কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো।
ঘনত্ব
সুন্দরবনের মধু কখনোই ঘন হয় না। আপনি যখন এই মধু হাতের আঙুলে নেবেন তখন তা পানির মত করে পিছলে পরে যাবে। ঘনত্ব কম হওয়ার কারণে যখন একপাত্র থেকে অন্য পাত্র অথবা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া হয় তখন দুধের মত সাদা ফেনা হয়।
ফেনার সাথে সাথে একটি গ্যাসের উৎপত্তি হয়। অনেকটা কোন ডিটারজেন্ট যখন পানির সাথে মিশিয়ে ঝাঁকি দিলে অনেক ফেনা আর বুদ্বুদ গ্যাস হয় ঠিক তেমনি। তবে সহজেই এই অবস্থা থেকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। এই জন্য শুধু মধু যে পাত্রে আছে তা স্থির করে রাখতে হয়। এতে ধীরে ধীরে সেই ফেনা বিলীন হয়ে যাবে এবং গ্যাস নির্মূল হয়ে যাবে।
রং
সুন্দরবনের মধু সবসময় অ্যাম্বার রঙের হয়ে থাকে। যেহেতু এখানে বিভিন্ন ফুলের মধু থাকে সেহেতু এটি রঙের দিক দিয়ে কিছু তারতম্য দেখায়। তবে প্রধান রং অ্যাম্বার থাকলেও তা লাইট, ডার্ক বা হালকা ডার্ক হতে পারে।
ঘ্রাণ
সুন্দরবনের মধুর এত নাম ডাক হওয়ার পেছনে এর ঘ্রাণ অনেক বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সাধারণত সুন্দরবনের মধু হচ্ছে হরেক রকমের সংমিশ্রণ। প্রতিটি ফুলের আলাদা আলাদা ঘ্রাণ ও বৈশিষ্ট্য আছে। এই কারণে এই মধু থেকে অনেক উৎকৃষ্ট সুঘ্রাণ আসে। তাছাড়া এতে একটু হালকা টক টক ঘ্রাণ থাকে।
স্বাদ
স্বাদের দিক দিয়ে বলতে গেলে সুন্দরবনের মধু অন্য সকল মধু থেকে আলাদা। বিশেষ করে কেওড়া ফুলের মধু মিশ্রণ থাকায় স্বাদ টক টক হয়। কারণ এই ফুলের মধু খেতে একটু টক টক লাগে। আর সুন্দরবনের মধুতে এই ফুলের নেকটার অবশ্যই উপস্থিত থাকে। এই জন্য স্বাদ টক টক কিন্তু মিষ্টি লাগে। অন্যদিকে এই মধুতে চিনির থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ গুন বেশি মিষ্টি থাকে।
আর্দ্রতা
সুন্দরবনের মধুতে আর্দ্রতা বেশি থাকে। অর্থাৎ সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকায় বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। এই কারণে সে সকল এলাকায় যে মধু উৎপন্ন হয় তা পাতলা ও হালকা রঙের হয়ে থাকে। এই কারণে সুন্দরবনের মধু পাতলা হয়।
প্রোটিনযুক্ত পোলেন মিশ্রিত
সুন্দরবনের মধুতে প্রোটিনযুক্ত পোলেন মিশ্রিত থাকে। এটি চাক থেকে মধু চেপে বের করার পর তা যে পাত্রে রাখা হয় তার ঠিক উপরে একটি লেয়ার বা আস্তরণ পরে। এটি সাধারণত প্রোটিনযুক্ত পোলেন বা গাদ নামে পরিচিত। যদি আপনি সরাসরি সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকা থেকে এই মধু কিনেন তবে অবশ্যই এটি দেখে নিবেন। তবে অনলাইনে নিলে তারা এই স্তর ছেঁকে তারপর বোতলজাত করে। এই জন্য পোলেন না থাকলে বিভ্রান্ত হবেন না।
সুন্দরবনের মধুর উপকারিতা
নিচে সুন্দরবনের মধুর উপকারিতা বর্ণনা করা হলো।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য মধু অনেক ভালো কাজ করে। বিশেষ করে সুন্দরবনের মধুতে বিভিন্ন ফুলের সংমিশ্রণ থাকায় তা রোগ প্রতিরোধ করার উপাদানে ভরপুর থাকে। বিশেষ করে এই মধুতে অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, খনিজ ও বিভিন্ন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বিদ্যমান। এগুলো দেহের জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া দূর করে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে
মধু দেহের স্বাভাবিক রক্ত চলাচল করার জন্য যে যে উপাদান প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করে। বিশেষ করে সুন্দরবনের মধুতে এই সকল উপাদান বেশি পরিমাণে থাকে। কারণ এক সাথে একটি মধুর মধ্যে এত এত ফুলের নেকটার থাকে না। অন্যান্য মধু শুধু একটি প্রধান ফুলের উপর নির্ভর করে তৈরি হয় কিন্তু সুন্দরবনের মধুর বিষয় একদম আলাদা। অর্থাৎ সুন্দরবনের মধু খেলে দেহের রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় যা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
ত্বকের দাগ দূর করে
মধু একটি প্রাকৃতিক রূপচর্চার উপাদান। ত্বকের উপরে থাকা ময়লা, জীবাণু, শুষ্ক বা মরা কোষ এবং কালো দাগ দূর করার জন্য মধু অনেক ভালো কাজ করে। সুন্দরবন থেকে যে মধু সংগ্রহ করা হয় তা আরও দ্রুত ও পরিপূর্ণভাবে কাজ করে। এই কারণে অনেকে এই মধু ত্বকে মাখার পাশাপাশি খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করে রাখে।
হজম বৃদ্ধি করে
হজম শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে সকল এনজাইম প্রয়োজন তার সবকিছুই সুন্দরবনের মধুতে অগণিত মাত্রায় রয়েছে। অর্থাৎ সুন্দরবনের মধু হজম বৃদ্ধি করার এনজাইমের কারখানা।
যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে
সুন্দরবনের মধু একটি মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। এতে রয়েছে সকল ধরনের প্রয়োজনীয় খনিজ, ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। এটি দেহের যৌন স্বাস্থ্যের যত্ন নেয় এবং তা সাবলীল রাখে। রসুন যেমন যৌন স্বাস্থ্য সুগঠিত রাখে ঠিক তেমনি মধুও একই কাজ করে তবে কার্যকরীভাবে।
গ্যাস্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ করে
মধু পরিমাণ মত এবং নিয়ম করে খেলে তা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধানে কাজ করে। এই কারণে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মধু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। যে মধু যত উৎকৃষ্ট ও খাঁটি তা তত ভালো কাজ করে। সেই দিক থেকে সুন্দরবনের খাঁটি মধুর কোনো তুলনাই নেই।
দেহ প্রাণবন্ত রাখে
মধুকে দেহের জন্য মহৌষধ বলা হয় একটি কারণে আর তা হলো এটি যখন নিয়মিত খাওয়া হয় তখন কোন রোগ দেহে বাসা বাঁধতে পারে না। বিশেষ করে জ্বর, সর্দি, ঠান্ডা জাতীয় সমস্যা সহ অন্যান্য সাধারণ রোগ হয় না। এতে দেহ বেশি সময় ধরে প্রাণবন্ত ও কর্মক্ষম থাকে।
সুন্দরবনের মধু কীভাবে সংগ্রহ করে?
সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করা একটি প্রচলিত পেশা। সাধারণত সারাবছরেই কিছু পরিমাণ মধু এই বন থেকে সংগ্রহ করা হয় তবে মধু সংগ্রহের প্রধান সময় হচ্ছে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত। কারণ এই সময় সুন্দরবনে নানা ধরনের ফুল ফোটে। সেগুলো থেকে নেকটার সংগ্রহ করে তা চাকে জমা করে মধুতে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে, মৌয়াল রা দল বেঁধে ধোঁওয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়িয়ে তা থেকে মধু সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে তা লোকাল বাজারে বিক্রি সহ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে পরবর্তীতে সেই মধু দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়।