সুনামগঞ্জ একটি অনিন্দ্য সুন্দর জেলা যা সিলেট বিভাগে অবস্থিত। হাওড় এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এটি পাহাড় ও উঁচু টিলা দ্বারা সমৃদ্ধ। এখানে দেশবরেণ্য অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন। এই এলাকা যেমন অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা তেমনি এই অঞ্চলের দেশবন্ধুর মিষ্টি সবার কাছে প্রিয়। আমাদের আজকের লেখায় আমরা দেশবন্ধুর মিষ্টি কেন এত বিখ্যাত এবং এর পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
আমরা যেমন মাছে ভাতে বাঙ্গালী। ঠিক তেমনি খাবারের শেষে মিষ্টি জাতিয় খাবার না হলে যেন চলেই না। অঞ্চলভেদে ও জেলা অনুযায়ী বেশ অনেক ধরনের বিখ্যাত মিষ্টি রয়েছে। যা কেবল সুস্বাদুই নয় বরং স্বাদ অতুলনীয়।যেমন মতিচুর লাড্ডু, মুন্সিগঞ্জ ভাগ্যকুলের মিষ্টির, গাইবান্ধার রসমুঞ্জরী, কুমিল্লার রসমালাই, যশোরের জামতলার মিষ্টি, সন্দেস, বালিশ মিষ্টি, মুক্তাগাছার মন্ডা, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, পোড়াবাড়ির চমচম ইত্যাদি। সুনামগঞ্জের দেশবন্ধুর মিষ্টি ও ঠিক বিখ্যাত মিষ্টি।
দেশবন্ধুর মিষ্টি কেন বিখ্যাত?
মিষ্টি বাঙালি জাতির একটি সুপরিচিত খাবার। মিষ্টি প্রিয় এই জাতি আদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটু আধটু মিষ্টি জাতীয় খাবার রাখতে অভ্যস্ত। এই কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মিষ্টি ও সন্দেশ তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের পূর্বে এই উপমহাদেশে যখন জমিদার ও রাজা বাদশাদের শাসন ছিল তখন তারা অতিথি আপ্যায়ন ও নিজেদের ভোজনের জন্য মিষ্টির প্রচলন শুরু করে।
তারপর সেগুলো সাধারণ মানুষের নাগালে আসে এবং এর জনপ্রিয়তা হুর হুর করে বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকাভিত্তিক মিষ্টি বিখ্যাত হতে থাকে। একেক অঞ্চলের মিষ্টির স্বাদ একেক রকমের হলেও কিছু কিছু মিষ্টি মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।
দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার তাদের মধ্যে অন্যতম। মূলত এই প্রতিষ্ঠানে সকল ধরনের মিষ্টি তৈরি করা হলেও রসমালাই সব থেকে বেশি মানুষের মন জয় করেছে। দেশবন্ধুর রসমালাই পুরোপুরি রসের মধ্যে ডুবে থাকে। চামচ দিয়ে যখন মিষ্টিতে চাপ দেওয়া হয় তখন স্পঞ্জের মত করে সেই মিষ্টি রস ছেড়ে দেয়।
বাদামি রঙের দেশবন্ধু মিষ্টি খেতে অনেক সুস্বাদু। যখন এই রসমালাই মুখে দেওয়া হয় তখন তা পুরো মুখ রসে ভরিয়ে ফেলে। তারপর স্পঞ্জের মত মিষ্টি মুখে সুন্দর করে ভেঙে মিলিয়ে যায়। এই কারণে যখন কেউ এই মিষ্টি খায় তখন একটি অন্যরকম স্বাদ অনুভব করে।
যা যে কোনো মিষ্টি প্রেমিকে ইম্প্রেস হতে বাধ্য করে। অন্যদিকে, দেশবন্ধুর মিষ্টি শুধু ভারতের কোলকাতা ও বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে পাওয়া যায়। আপনি যদি কখনো সুনামগঞ্জ শহরে জান তাহলে অবশ্যই এখানকার দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যাবেন। একবার এই মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করলে খাওয়ার পাশাপাশি আপনি অবশ্যই পারসেল নিয়ে যাবেন।
সুনামগঞ্জের দেশবন্ধুর মিষ্টির ইতিহাস
দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ইতিহাস প্রায় ১০০ বছর পুরোনো। ধারণা করা হয়ে থাকে ১৯২১ সালের দিকে বিভূতিভূষণ চৌধুরি তৎকালীন বর্ধমান থেকে চাকরি ছেড়ে কোলকাতা শহরে চলে আসেন। এখানে তিনি শহরের বড়বাজার এলাকায় অনেক সুন্দর একটি দোকানের জায়গা পছন্দ করেন।
তারপর সাতপাঁচ না ভেবে সেখানে একটি মিষ্টির দোকান প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তা ধীরে ধীরে আশেপাশে এলাকায় পরিচিতি পেটে থাকে। একদিন বিভূতিভূষণ চৌধুরীর বন্ধু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এই দোকানে আসেন। তিনি এই মিষ্টি পরখ করে এত বেশি আনন্দিত হয় যে পরবর্তীতে তার নামেই দোকানের নামকরণ করা হয়।
কোলকাতা শহরের দেশবন্ধু মিষ্টি সময়ের সাথে সাথে পুরো অঞ্চল জুড়ে পরিচিত লাভ করে। এই দোকানে বিভিন্ন সময়ে লোকাল মানুষ ছাড়াও দূরদূরান্তের মানুষ মিষ্টির স্বাদ নিতে যাওয়া শুরু করে। কালক্রমে এই মিষ্টির দোকানের আদলে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ এলাকায় দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দোকানের প্রচলন শুরু হয়।
নাম একই ধরনের হলেও দুই অঞ্চলের দোকানের কার্যক্রম এবং মিষ্টির আইটেম ভিন্ন। বিশেষত সুনামগঞ্জের দেশবন্ধুর মিষ্টি বলতে সাধারণত রসে ডোবানো রসগোল্লাকে বোঝানো হয়। এটি দেখতে বাদামি রঙের হয় এবং সাধারণ মিষ্টির থেকে একটু বড় আকৃতির হয়।
সুনামগঞ্জ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে থেকেই অনেক বিখ্যাত অঞ্চল হিসেবে সুপরিচিত। এখানে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি বর্গ জন্মানোর পাশাপাশি এই হাওর অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারখানা। এই সুনাম ও সুখ্যাতি আরও বেশি বৃদ্ধি করেছে এখানকার বিখ্যাত দেশবন্ধুর মিষ্টি।
সুনামগঞ্জ শহরের স্টেশন রোডে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে একটি সুপরিচিত দোকান আছে। এখানে বিখ্যাত রসগোল্লা সহ প্রায় সকল ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। বিশেষ করে এখানকার সন্দেশ, রসমালাই ও রসগোল্লা স্বাদে অনন্য হয়। আপনি যদি এই শহরে আসেন তাহলে ভাত খাওয়ার জন্য অবশ্যই লঞ্চঘাটে যাবেন এবং মিষ্টি পছন্দ করলে স্টেশন রোডের দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যাবেন।
দেশবন্ধু মিষ্টির রেসিপি
নিচে দেশবন্ধুর মিষ্টি কীভাবে তৈরি করা হয় তা বর্ণনা করা হলো। সাধারণত কোন মিষ্টি তৈরি করার জন্য বিশেষ দুইটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। দেশবন্ধুর মিষ্টি তৈরির ক্ষেত্রেও এর কোনো বিকল্প নেই। চলুন মিষ্টি বানানোর ধাপগুলো বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
উপকরণ
দুধ, ছানা, এলাচ গুঁড়া, ভিনেগার, ময়দা
প্রথম ধাপ
দেশবন্ধুর মিষ্টি তৈরি করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন পরবে গাভীর খাঁটি দুধ যেখানে কোনো পানি মেশানো নেই। তারপর সেই দুধ কোনো প্রকারের পানি ব্যবহার না করে জ্বাল দেওয়া শুরু করতে হবে। সাধারণত মাটির চুলায় টানা ১৫ থেকে ২০ মিনিট জ্বাল করলে দুধ পরিপূর্ণ জ্বাল হবে। এখন এই দুধ যখন ঠান্ডা হওয়া শুরু হবে তখন তাতে পরিমাণ মত ভিনেগার দিতে হবে।
এতে দুধ জমা শুরু করবে এবং ছানা তৈরি হবে। যখন সম্পূর্ণ দুধ জমে ছানা হবে তখন সেই ছানা একটি কাপড়ে নিয়ে তা চেপে পানি বের করে দিতে হবে। তারপর সেই ছানা ওই কাপড়ে রেখে উঁচু স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এতে সেই ছানা থেকে অবশিষ্ট পানি ঝরে যাবে।
যখন ছানা থেকে একদম পানি ঝরে যাবে তখন সেই ছানার সাথে হালকা পরিমাণ ময়দা মেশাতে হবে। তারপর সেই ছানা ভালো করে ডলে খামির তৈরি করতে হবে। খামির হয়ে গেলে হাতে সামান্য ঘি অথবা খাওয়ার তেল মিশিয়ে ছোট ছোট ছানার দলা তৈরি করতে হবে। ছানার দলা তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো একটি পাত্রে রেখে দিতে হবে এবং পরবর্তী ধাপের কাজ শুরু করতে হবে।
পরের ধাপ
এখন ছানা তৈরি হওয়ার পর সেগুলো একটি সিরা ভর্তি কড়াইয়ে ৫ থে ৮ মিনিট জ্বাল করে ভেজে নিতে হবে। এতে ছানা সাদা রং থেকে বাদামি রং ধারণ করবে। তারপর সেই রস থেকে উঠিয়ে আগে থেকে চিনি দিয়ে তৈরি করা সিরায় ডুবিয়ে রাখতে হবে। প্রথম ধাপে ছানার সাথে অবশ্যই চিনি এবং দুধের মিশ্রণ এবং এলাচের গুঁড়া মেশাতে হবে।
এতে রসগোল্লা থেকে সুমিষ্ট ঘ্রাণ আসবে। তো এভাবেই সহজে সুনামগঞ্জের দেশবন্ধুর বিখ্যাত মিষ্টি তৈরি করা হয়। এই মিষ্টির এরকম তৈরি প্রণালি একে অন্যান্য মিষ্টি থেকে আলাদা করেছে। এই কারণে সময়ের সাথে সাথে দেশবন্ধুর মিষ্টি লোকাল এলাকার সাথে সাথে অন্যান্য জেলায় সুপরিচিত পাচ্ছে।