নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা একটি আপোষহীন বিষয়। কারণ আমাদের বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। অনিরাপদ খাদ্য যেমন আমাদের স্বাস্থ্যহানির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় তেমনি অর্থ ব্যয়ের কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে আমাদের বেশ কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের আজকের লেখায় নিরাপদ খাদ্য কি এবং কীভাবে তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য বলতে কি বোঝায়?
নিরাপদ খাদ্য বলতে স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্যকে বোঝায়। অর্থাৎ যে পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক ভাবে খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন, প্রস্তুত ও পরিবেশন করা হয় তাকে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা বলে। খাদ্য আমাদের একটি মৌলিক চাহিদা। খাদ্য ছাড়া আমাদের সহ কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব।
প্রস্তর যুগে যখন মানুষ পশু শিকার করে তাদের খাদ্য ব্যবস্থা করতো তখন জীবন অনেক কঠিন থাকলেও খাদ্যের নিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু বর্তমানে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। এতে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হচ্ছে না।
এর কারণ যে সকল রাসায়নিক এবং কেমিক্যাল ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে তা মানব দেহের জন অনেক ক্ষতিকারক। রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকে অস্বাস্থ্যকর কেমিক্যাল থাকে যা জমি এবং মানুষের শরীরের জন্য বিষের মত ক্ষতিকারক।
কেমিক্যাল বাদেও খাদ্যতে বিভিন্ন প্রকারের জীবাণু ও অণুজীব থাকে। এগুলো মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। যা সাধারণ শারীরিক সমস্যা থেকে অনেক জটিল সমস্যায় রূপান্তর হয়। এ কারণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও জীবাণুমুক্ত খাদ্যকে নিরাপদ খাদ্য বলে।
নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব
নিরাপদ খাদ্য পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমরা সুষম খাদ্য খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখতে পারি। তাছাড়া অনিরাপদ খাদ্য আমাদের শরীরে যেমন রোগ ধরায় তেমনি স্বাস্থ্যহানির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ফুড পয়জনিং সহ ফুড ইনফেকশন সমস্যার সম্মুখীন হয়। এদের মধ্যে কমপক্ষে 420,000 মানুষ অসুস্থতার কারণে মারা যায়। এই অসুস্থতার মধ্যে পেটের অসুখ সব থেকে বেশি ঘটে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নেওয়ার ফলে প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ তাদের প্রাণ হারায়। যাইহোক, নিচে নিরাপদ খাদ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বর্ণনা করা হলো।
খাদ্যজনিত অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা
আমরা আগেই জেনেছি খাদ্যজনিত অসুস্থতার কারণে সাধারণ পেট ব্যথা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যা আমাদের জন্য একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি করে। অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করলে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর আক্রমণে ফুড পয়জনিং থেকে ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস এ, বমি সহ নানান শারীরিক সমস্যার উদ্ভব হয়। এই সকল স্বাস্থ্যঝুঁকির থেকে নিরাপদ থাকতে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। নাহলে দিনের পর দিন কেমিক্যাল ও রাসায়নিক সারযুক্ত খাবার গ্রহণ করার দরুন আমরা মরণঘাতি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাব।
খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে খরচ হ্রাস করে
একটি প্রতিষ্ঠানের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। উৎপাদন থেকেই যদি উক্ত খাদ্য নিরাপদ হয়ে আসে তাহলে কিন্তু তাদের এই বিশাল ইনভেস্টমেন্ট অন্য কাজে লাগাতে পারতো। অর্থাৎ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে এত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হতো না যা সবদিক বিবেচনা করে খরচ হ্রাস করতো।
খাদ্যবজ্র কমায়
যেহেতু নষ্ট ও ভাইরাস যুক্ত খাদ্য আমাদের খাওয়ার উপযোগী হয় না সেহেতু প্রতিনিয়ত তা বজ্রে পরিণত হয়। এছাড়া অনিরাপদ খাদ্য খুব তাড়াতাড়ি খাওয়ার অযোগ্য হয়। যদিও বিভিন্ন উপায়ে সে খাদ্য সংরক্ষণ করা যায় তবুও অনেকদিক বিবেচনা করলে বুঝা যায় সেগুলো আসলে আমাদের জন্য উপযোগী না। যাইহোক, যদি বৈজ্ঞানিক ভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে খাদ্য বজ্র অনেক পরিমাণ কমে যাবে।
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিনের সঙ্গী – নিরাপদ ও খাঁটি মধু
টেকসই খাদ্য উৎপাদন
অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন মানুষের মনে উক্ত খাদ্য সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যেমন বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগি সচরাচর সবাই খায় না। তাছাড়া পাঙ্কাশ মাছ খেতেও অনেক মানুষ অনীহা প্রকাশ করে। এগুলোর কারণ মানুষ জানে এসব খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উৎপাদন করা হয় না। যে কারণে মানুষ এ সকল খাদ্য থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যাপারে মানুষ বেশি আগ্রহ দেখায় যা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।
সুস্থ জীবনযাপন
সুস্থ জীবনযাপন করার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা। অনিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা একাধারে যেমন বিভিন্ন রোগ ডেকে আনে তেমনি অর্থের অপচয় ঘটায়। অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে শরীর সুস্থ ও পরিপুষ্ট থাকে। এই সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায় সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্যের কোন বিকল্প নেই।
নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি
নিরাপদ খাদ্য বলতে পুষ্টিকর খাদ্যকে বোঝায়। নিচে কি কি উপাদান থাকলে একটি খাদ্যকে নিরাপদ ও পুষ্টিকর বলা হয় তা বর্ণনা করা হলো।
আমিষ
মানবদেহ পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন হলো ক্যালোরির। আমাদের দেহের প্রায় ১০-১২% ক্যালোরি আমরা আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে পেয়ে থাকি। প্রাণিজ এবং উদ্ভিজ্জ উৎস যেমন মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল, বাদাম, বীজ ইত্যাদি থেকে আমিষ পাওয়া যায়। প্রাণী দেহের জন্য আমিষের বিকল্প কিছু নেই।
শর্করা
শর্করা আমাদের দেহে শক্তি সরবরাহ করে। প্রতিদিন চলার জন্য আমাদের মোট ক্যালরির ৬০-৭০% শর্করা থেকে আসে। সাধারণত শর্করার প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে আলু, চিরা, মুড়ি, ভাত, পাস্তা, নুডুলস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে গমের আটার রুটি, অটস এবং লাল চাল সব থেকে বেশি শর্করা সরবরাহ করে। এই কারণে যারা নিয়মিত রুটি খায় তাদের শারীরিক শক্তি অন্য মানুষদের থেকে বেশি হয়ে থাকে।
ভিটামিন
ভিটামিন ও খনিজ আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া দেহের কোষ গুলো সক্রিয় ও সজেত রাখার কাজ করে। সবুজ শাকসবজি এবং ফলমূল ভিটামিন ও খনিজ লবণের সব থেকে ভালো উৎস, যদিও অন্যান্য খাবার থেকে ভিটামিন ও খনিজ পাওয়া যায় তবে শাকসবজি ও ফলমূল এর প্রধান সরবরাহকারী।
চর্বি জাতীয় খাবার
চর্বি আমাদের শরীরের জন্য একাধারে ভালো এবং মন্দ উভয়ই। কারণ অতিরিক্ত চর্বি আমাদের শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলে যার মধ্যে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, মেদ অন্যতম। তবে দেহের মোট ক্যালরির ২০-২৫% আসে স্বাস্থ্যকর চর্বি জাতীয় খাবার থেকে। উপকারী চর্বি জাতীয় খাবারের মধ্যে ঘি, তেল (অলিভ, সরিষা, বাদাম, সানফ্লাওয়ার), মাখন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। চর্বি আমাদের দেহের পুষ্টিগুণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
পানি
আমরা জানি পানির অপর নাম জীবন। আসলে বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন কারণ মানব শরীরে ৬০% পানি থাকে। পানি শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপের জন্য অতি জরুরি। বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কর্মক্ষম রাখার পাশাপাশি কোষ সতেজ রাখার জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি। আর্সেনিক ও ব্যাকটেরিয়া মুক্ত পানি মানব দেহের জন্য শক্তি সঞ্চায়ক হিসেবে কাজ করে।
দুগ্ধজাত খাবার
মানুষের দেহের অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস অন্যতম। দুধ, দই, ঘি, পনির ও ছানায় এগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই পুষ্টি উপাদানগুলো মানবদেহের হাড় মজবুত করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেহকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখে। অন্যদিকে দুগ্ধজাত খাবার দেহের আমিষের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে।
নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে আমাদের প্রান্তিক পর্যায় থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে অজান্তেই মানুষ তাদের নিজেদের খাবারে বিস মিশিয়ে নিজেরাই খাবে। এতে এক সময় চরম স্বাস্থ্য বিপর্যয় সংঘটিত হবে।