আমরা বিভিন্ন সময় নানা কারণে বাসি এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষিত খাবার গ্রহণ করি। এতে প্রায় সময় আমাদের ব্যাকটেরিয়া ঘটিত নানান সমস্যা যেমন ফুড পয়জনিং এর শিকার হতে হয়। যদিও এটি খুব সাধারণ পেটের সমস্যা তবে অনেক সময় অসাবধানতার কারণে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। নিচে ফুড পয়জনিং কি এবং কীভাবে তা প্রতিরোধ করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ফুড পয়জনিং কি?
ফুড পয়জনিং একটি ইংরেজি শব্দ যার বাংলা হলো খাদ্যে বিষক্রিয়া। জীবাণুযুক্ত বাসি খাবার খেলে আমাদের পেটে ব্যথা সহ যে পাতলা পায়খানা এবং বমি হয় তাকে ফুড পয়জনিং বলে। এটি আপাত দৃষ্টিতে একটি সাধারণ পেটের রোগ। কিন্তু সময় মত সুচিকিৎসা না করালে ফুড পয়জনিং থেকে মারাত্মক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাধারণত খাদ্যে বিভিন্ন রকম জীবাণু এবং অণুজীবের কারণে ফুড পয়জনিং সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ বাসি-পচা খাবার যখন আমরা গ্রহণ করি তখন তা আমাদের পাচন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। এতে পেটে দীর্ঘসময় খাবার জমা হয়ে থাকে যা জীবাণু এবং অণুজীবদের পাকস্থলীতে আক্রমণ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এতে পাতলা পায়খানা, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, অস্বস্তি, মাথা ঘোড়া, বমিসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে খাবার রান্না ও সংরক্ষণ করলে ফুড পয়জনিং সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
ফুড পয়জনিং কেন হয়?
ফুড পয়জনিং হওয়ার সব থেকে বড় কারণ জীবাণুযুক্ত খাবার গ্রহণ করা। খাবার সংগ্রহ, প্রস্তুত এবং সংরক্ষণ করার সময় সংক্রামক জীবাণু খাবারের মধ্যে ক্রস কন্টামিনেশন হয়ে ছড়িয়ে যায়। সাধারণত খাবারে নিম্নে বর্ণিত কিছু জীবাণু ও অণুজীব থাকলে খাদ্যে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
হেপাটাইটিস এ
এটি একটি লিভারের রোগ যা মল-মুত্র এর মাধ্যমে ছড়ায়। হেপাটাইটিস ভাইরাসের পাঁচটি ভেরিয়েন্টের মধ্যে হেপাটাইটিস এ সরাসরি লিভারে আক্রমণ করে। আপনার গ্রহণকৃত খাবারে যদি এই ভাইরাস থেকে থাকে তবে আপনিও হেপাটাইটিস বা জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া এই সমস্যার কারণে আপনার পেটে ব্যথা সহ খাবারে অরুচি সমস্যার দেখা দিতে পারে।
এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে উপসর্গ দেখা না দিলেও কিছু দিনের মধ্যেই আপনার চেহারা হলুদ হয়ে আসবে। ফুড পয়জনিং এর মাধ্যমে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে নচেৎ লিভার ফেলিওর সহ মৃত্যু ঘটতে পারে। বর্তমানে নিয়মিত চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস নির্মূল করা যায়।
ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম (Clostridium Botulinum)
এই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করার ১২ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। বিশেষ করে টিনের ক্যানে সংরক্ষণ করা খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, লবণ দিয়ে সংরক্ষিত মাছ এবং অ্যালুমিনিয়াম ফুয়েল মুড়িয়ে সেদ্ধ করা খাবারে এই ব্যাকটেরিয়া সব থেকে বেশি আক্রমণ করে।
ই-কোলাই (Escherichia Coli)
এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত প্রাণীর মল দ্বারা ছড়ায়। বিশেষ করে গরুর মাংস, কাঁচা সবজি, দুধ, অল্প তাপে রান্না করা মাংসে এই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আক্রমণ করার ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে দেহে এই জীবাণুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়ার ফলে ডাইরিয়ার সাথে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার (Campylobacter)
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে এই ব্যাকটেরিয়া থাকার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে কাঁচা মাংস ও পোল্ট্রি ফিডে প্রাণীর মল দ্বারা এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। শরীরে প্রবেশ করার ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে।
ফুড পয়জনিং কত প্রকার?
জীবাণুর আক্রমণের ভিত্তিতে ফুড পয়জনিং সাধারণত চার প্রকার। নিচে কি কি কারণে ফুড পয়জনিং হয় তা বর্ণনা করা হলো।
প্রাকৃতিক
প্রাকৃতিক ভাবে অনেক খাবারে অস্বাস্থ্যকর উপাদান থাকে যা আমাদের শরীর ভেদে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে কিছু প্রজাতির মাশরুম ও Guaya নামক একটি লিচু জাতীয় ফলে প্রাকৃতিক টক্সিন থাকে যা মানবদেহে ফুড পয়জনিং এর মত সমস্যার সৃষ্টি করে।
ব্যাকটেরিয়া
খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটার জন্য সব থেকে বেশি দায়ী হলো ব্যাকটেরিয়া। বিশেষ করে Clostridium Botulinum, Enterotoxins , Enterotoxins, Enterohaemorrhagic ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ খাবার যেমন, দুধ, পোল্ট্রি, কাঁচা গরুর মাংস, শাকসবজি, ভুট্টা ঠিক মত রান্না বা ধুয়ে না খেলে পেটে সমস্যা দেখা দেয়।
ফাঙ্গাস
বিভিন্ন প্রকৃতির ফাঙ্গাস যেগুলো বার্লি, গম, জোয়ার, শস্যদানা, বাদাম ইত্যাদিতে আক্রমণ করে তা গ্রহণ করলে ফুড পয়জনিং সমস্যা হয়।
কেমিক্যাল
বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান সহ সীসা, পারদ ও ক্যাডমিয়াম জাতীয় ধাতু সমৃদ্ধ খাবার ফুড পয়জনিং এর অন্যতম কারণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গ্রহণ করা অনেক খাবারে এগুলো বিদ্যমান থাকে যা পেটে নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে।
ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ
খাদ্যে বিষক্রিয়া হওয়ার বেশ কয়েকটি লক্ষণ বিদ্যমান যা নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
- বমি হওয়া
- উচ্চমাত্রার জর হওয়া
- পাতলা পায়খানা
- ডায়রিয়া
- মাথা ঘোরা
- পানি শূন্যতা
- গলা শুকিয়ে যাওয়া
- পেট ফাঁপা
- খিদে না লাগা
- মাথা ব্যথা
- পেটে ব্যথা
- সমস্ত শরীরে ব্যথা
ফুড পয়জনিং হলে কি করবেন?
ফুড পয়জনিং এর শিকার হলে কি কি করা উচিত তা নিচে বর্ণনা করা হলো।
রোগ নির্ণয়
সাধারণত ফুড পয়জনিং সমস্যা ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। তবে যদি দেখেন কোন রোগীর সমস্যা ৭ দিনের মধ্যে ঠিক না হচ্ছে তখন ধরে নিবেন সমস্যা জটিল আঁকার ধারণ করেছে। এখন পেটে সমস্যা হলেই যে তা ফুড পয়জনিং হবে তা কিন্তু নয়। রোগীর অন্য কোন সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
ডাক্তার রোগীর সমস্যা যাচাই বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নিবেন যে এটি ফুড পয়জনিং না অন্য কোন সমস্যা। তো ফুড পয়জনিং সমস্যা হলে সমাধানের জন্য সর্বপ্রথম রোগ নির্ণয় করতে হবে।
সাধারণ চিকিৎসা
যদি ফুড পয়জনিং হয়ে যায় তবে কিছু সাধারণ এবং ঘরোয়া চিকিৎসা আছে যা রোগীয়ে দ্রুত সারিয়ে তুলতে সক্ষম। আমরা জানি ফুড পয়জনিং হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বমি ও পাতলা পায়খানা হয়। এতে শরীর থেকে অনেক বেশি পরিমাণ পানি বের হয়ে পানি স্বল্পতার সৃষ্টি করে।
তো এই সময় রোগীকে বেশি বেশি স্যালাইন পানি সহ ডাবের পানি পান করাতে হবে। না হলে ডিহাইড্রেশনে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হবে, এমনকি মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
জটিল চিকিৎসা
সাধারণ চিকিৎসায় যদি রোগী ভালো না হয় তবে অবশ্যই হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে। সেখানে রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে অ্যান্টিবায়োটিক এবং শিরায় দেওয়া স্যালাইন ব্যবহার করে অবস্থা স্বাভাবিক করে তোলা হয়।
কারণ দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া না হলে পানি স্বল্পতার কারণে শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় থাকে না যা অতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মহিলার এরকমের সমস্যা হলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।
খাবার পরিবর্তন
ফুড পয়জনিং এর সময় আমাদের চর্বিযুক্ত খাবার, দুগ্ধজাত খাবার, মশলাদার এবং ভাজা খাবার, উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার, ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে যেতে হবে। তবে এই সময় শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক রাখার জন্য নিম্নলিখিত খাবার নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে। যেমন-
- বিভিন্ন ফলের রস
- ডাবের পানি
- স্যালাইন
- টোস্ট
- সিদ্ধ শাকসবজি
- ভাত
- কলা
- দই
- আদা চা
উপরে বর্ণিত খাবার গুলো ফুড পয়জনিং সমস্যার সময় খেলে রোগী যেমন শারীরিক শক্তি পায় তেমনি ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ হয়। নিয়মিত তদারকি ও পরিষ্কার-পরিছন্ন পরিবেশে খাবার উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করলে ফুড পয়জনিং সহ এরকম আরও অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আজকের এই লেখায় এই সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে।