সুন্দরবন থেকে যে মধু পাওয়া যায় তার মধ্যে খলিশা ফুলের মধু সব থেকে বেশি পিওর ও অরগানিক। এই মধুতে প্রায় ৯০% মত খলিশা ফুলের মধু থাকে। সুস্বাদু এই মধু দেশের বাজারে গুণগত মান হিসেবে ৪০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। নিচে সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু চেনার উপায়, এর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
খলিশা ফুলের মধু চেনার উপায়
সুন্দরবনকে মধুর রাজ্য বলা হয়। আমাদের দেশের মত মধুর চাহিদার কমপক্ষে ৮০% পূর্ণ হয় সুন্দরবনের মধু দিয়ে। সাধারণত এই বনে নানা ধরনের ফুল ফোটে যা থেকে দেশের সব থেকে উৎকৃষ্ট মানের মধু হয়। যাইহোক, আমরা সুন্দরবনের মধু বলতে সাধারণত মিশ্র মধুকে বুঝে থাকি। অর্থাৎ সুন্দরবনের মধুতে পশুর, কেওড়া বাইন ও খলিশা ইত্যাদি ফুলের মধু মিশ্রিত থাকে।
তবে এই মিশ্র মধুর ভিড়ে সুন্দরবন থেকে দেশের সব থেকে বেশি দামি এবং সুস্বাদু খলিশা ফুলের মধু পাওয়া যায়। বনবিভাগের মতে প্রতি বছরের মার্চ মাসের শুরুতে সুন্দরবনে প্রায় সকল গাছে মুকুল আসে। কিন্তু সেই সময় সবার প্রথমে খলিশা ফুল ফোটে। অন্যান্য গাছে মুলুক থাকলেও সেগুলোতে দেরিতে ফুল ফোটে।
সাধারণত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেই সময় দলে দলে মৌমাছি চাক তৈরি করে তাতে খলিশা ফুলের মধু সংগ্রহ করে। খলিশা ফুল দেখতে উজ্জ্বল সাদা বর্ণের। এই ভুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি থেকে অনেক সুন্দর মিষ্টি গন্ধ আসে। এই জন্য খলিশা ফুলের মধু দেখতে পাতলা সাদা বর্ণের হয় এবং তা থেকে অনেক সুন্দর মিষ্টি গন্ধ আসে।
সুন্দরবনে খলিশা ফুলের মধু সংগ্রহ শুরু হয় পহেলা এপ্রিল থেকে যা পুরো দুই মাস ব্যাপী চলে। এই সময় মৌয়ালরা দল বেঁধে বনের ভেতরে যায় এবং যে যা পারে সে অনুপাতে মধু সংগ্রহ করে। খলিশা ফুলের মধু এত বেশি দামি হওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে এর উৎপাদন খুব সীমিত পরিমাণে হয়। অর্থাৎ মিশ্র ফুলের মধুর থেকে এর চাক খুব কম হয় যে কারণে দামের দিক দিয়ে এটি অনেক উপরে। তাছাড়া এই মধু অনেক বেশি মিষ্টি হয়ে থাকে।
উচ্চ পরিমাণে মিষ্টি স্বাদ এবং স্বল্প জোগানের সাথে খলিশা ফুলের মধুর অনেক উপকারিতা রয়েছে। নিচে এই ফুলের উপকারিতাগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
খলিশা ফুলের মধুর উপকারিতা
খলিশা ফুলের মধুকে পদ্ম মধু বলা হয়। এর দ্বারা একে অনেক উৎকৃষ্ট মানের মধু হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। মূলত খলিশা ফুলের মধু অনেক বেশি সুস্বাদু ও মিষ্টি ঘ্রাণ যুক্ত হয়ে থাকে। যে কারণে সবাই এই মধু অনেক বেশি পছন্দ করে। অন্যদিকে খলিশা ফুলের মধুর ব্যাপক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে যা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে
হৃৎপিণ্ড একটি প্রাণীর জন্য সব থেকে বড় পাওয়ার হাউজ। এখানে সমস্যা দেখা দিলে প্রাণী যেমন নিস্তেজ হয়ে যায় তেমনি ধীরে ধীরে প্রাণ হারিয়ে ফেলে। এই জন্য আমাদের এই অঙ্গের যত্ন নিতে হয়। তো আমরা প্রতিদিন যে ধরনের খাবার গ্রহণ করি ও যে পদ্ধতিতে জীবন পরিচালনা করি তাতে হৃৎপিণ্ড এবং এর স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি কমানোর জন্য আমাদের প্রয়োজন হয় উৎকৃষ্ট মানের টনিক। খলিশা ফুলের মধু হৃৎপিণ্ড এবং এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে।
রক্তের উপাদান বৃদ্ধি করে
এই মধু নিয়মিত সেবন করলে রক্তে থাকা হিমোগ্লোবিন সহ অন্যান্য উপাদানের অভাব পূরণ হয়। অর্থাৎ এই মধু নিয়মিত খেলে রক্তের উপাদান সঠিক মাত্রায় উৎপন্ন হয় এবং তা স্বাভাবিক রক্ত চলাচল নিশ্চিত করে।
হজম বৃদ্ধি করে
মধুকে একটি উৎকৃষ্ট মানের হজমবর্ধক বলা হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে মধু প্রাকৃতিকভাবে এনজাইমের কারখানা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে খালি পেটে মধু খেলে তা পেটের মধ্যে থাকা দূষিত গ্যাস বের করে দেয়। এতে থাকা এনজাইমগুলো হজম কোষ গুলোকে সচল করে এবং প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে। এই কারণে যখন হজম শক্তি কমে যায় তখন নিয়মিত খলিশা ফুলের মধু খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
কোষ্ঠকাঠিন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি ধীরে ধীরে দেহে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে পেটের জ্বালাপোড়া, আলসার ইত্যাদি সমস্যার পেছনে কোষ্ঠকাঠিন্য দায়ী। এই সমস্যা থেকে নিরাপদ থাকতে আমাদের সবসময় তরল ও নরম খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। তবে যদি কোনো কারণে এই সমস্যা হয়ে যায় তাহলে খলিশা ফুলের মধু সেবনে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে
মানবদেহে শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের। কারণ পুষ্টিকর খাদ্য থেকে দেহে প্রয়োজনীয় আমিষ, শর্করা, ভিটামিন এবং খনিজ প্রবেশ করে। এগুলো ক্যালোরি আকারে দেহের শক্তি বৃদ্ধি করে।
তো সেই প্রাচীন কাল থেকেই মধুকে একটি শক্তিবর্ধক হিসেবে সেবন করা হয়। বিশেষ করে খলিশা ফুলের খাঁটি মধু অনেক পুষ্টি সম্পন্ন একটি মধু। এতে থাকে পুষ্টি উপাদান দেহের পুষ্টির তারতম্য ঠিক করে ও নিয়মিত সেবনে নিয়ন্ত্রণ করে।
ফুসফুসের সমস্যা দূর করে
মধু ফুসফুসের সমস্যা দূর করার জন্য একটি প্রাকৃতিক উপাদান। যক্ষ্মা থেকে শুরু করে ফুসফুসের ইনফেকশন সহ প্রায় সকল ধরনের সমস্যার সমাধান করার পেছনে মধু কাজ করে। বিশেষ পদ্ধতিতে ও সঠিক উপাদান মিশ্রিত করে খলিশা ফুলের মধু দিয়ে ফুসফুসের সমস্যার নিরাময় করা সম্ভব।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে
ধারণা করা হয়ে থাকে গাজর গুঁড়ো করে তা খলিশা ফুলের মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে তা দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
আমাশয় দূর করে
পেটের এই জটিল রোগ ঠিক করার জন্য মধু অনেক ভালো কাজ করে। বলা হয়ে থাকে বরই গাছের ছালের গুঁড়ার সাথে খলিশা ফুলের মধু মিশিয়ে খেলে আমাশয় অনেক দ্রুত ভালো হয়ে যায়। তাছাড়া আমাশয় দূর করার জন্য বেল এবং আমের বাকলের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
পেটের প্রদাহ দূর করে
সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধুতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিমাইক্রোবিয়াল থাকে। যেগুলো পেটের নানা ধরনের পিরা থেকে মুক্ত রাখে। তাছাড়া দেহের যে কোন ঘা ও ব্যথা দূর করার জন্য খলিশা ফুলের মধু অনেক ভালো কাজ করে।
রূপচর্চায় উপকার করে
মধু একটি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার। অর্থাৎ ত্বকের যত্ন নেওয়ার জন্য যে যে প্রাকৃতিক উপাদান প্রয়োজন তার সবকিছু সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধ্যে উপস্থিত। এই কারণে বিভিন্ন রূপচর্চার জিনিসপত্র তৈরি করার সময় মধু ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করে
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য সুন্দরবনের খলিশা ফুলের কোনো জুড়ি নেই। এতে থাকা এন্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান দেহের মধ্যে থাকা জীবাণু ধ্বংস করে এবং রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
খলিশা ফুলের মধু রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে যে কারণে এর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। যা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা স্বাভাবিক রাখে।
কফের সমস্যা দূর করে
ঠাণ্ডার সমস্যা দূর করতে প্রাচীন কাল থেকেই মধুর ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের খাঁটি মধু যে কোনো কফের সমস্যা দূর করার জন্য পারদর্শী।
খলিশা ফুলের মধু কীভাবে খাবেন?
মধু খাওয়ার সব থেকে উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে খালি পেটে। সাধারণত প্রতিদিন সকালে এবং ঘুমানোর ঠিক এক বা দুই ঘণ্টা আগে মধু খাওয়া উত্তম। এছাড়া রুটির সাথে অথবা শরবত বানিয়ে যে কোন সময় তা খাওয়া যেতে পারে। সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু যে কোনো সময় খাওয়া যায়। তবে অবশ্যই পরিমাণ মত এবং গরম পানি ব্যতীত খেতে হবে। নিচে আরও কি কি উপাদানের সাথে এই মধু খাওয়া যায় তা দেওয়া হলো।
- চিনির বিকল্প হিসেবে খলিশা ফুলের মধু খাওয়া যায়।
- শরবতের সাথে এই মধু খাওয়া যায়।
- রুটি অথবা পিঠার সাথে এই মধু খাওয়া যেতে পারে।
- জেলি হিসেবে খাও যাবে।
- ঔষধ হিসেবে সেবন করা যায়
উপরে বর্ণিত পদ্ধতি বাদেও আরও অনেক ভাবেই এই মধু খাওয়া যায়। তবে সর্বোচ্চ পরিমাণ ফলাফল ও উপকারিতা পেটে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে অথবা রাতে ঘুমানোর আগে খাওয়া উত্তম।