অতি প্রাচীন, অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক হলো মধু। প্রাচীন কাল থেকে মধু সবার পরিচিত একটি খাবার। যা রূপচর্চা কাজেও ব্যবহার করা হয়। ফলে ত্বককে করে ময়েশ্চারাইজ। একটি মজার বিষয় হলো কেউ যখন সবসময় কর্কশ ও রাগ্বানিত ভাবে কথা বলে তখন মজার ছলে বলা হয় ”জন্মের সময় কি মুখে মধু দেওয়া হয়নি।” আসলে জন্মের সময় মুখে মধু দিয়ে নাকি কথাগুলো মিষ্টি হয়। এবার আলোচনা করা হবে মধুর কাকে বলে এবং এর বিস্তারিত সকল তথ্য।
মধু কি
মধু হলো প্রাকৃতিক ঔষধি গুন সম্পন্ন এক ধরনের ঘন তরল মিষ্টি জাতীয় পদার্থ। এটি আমাদের শরীরের ন্যাচারাল অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে থাকে। বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা রিফাইনকৃত সাদা চিনির বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন মধু।
ইসলাম ধর্মের পবিত্র আল কোরআনে মধু সম্পর্কে বর্ণিত আছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
”মৌমাছির উদর থেকে নিঃসৃত হয় বর্ণিল পানীয়। এতে মানুষের জন্যে রয়েছে নিরাময়।
জ্ঞানীদের জন্যে এর মধ্যেও রয়েছে ( আল্লাহর মহিমার) উজ্জ্বল নিদর্শন ।”
সুরা নাহল, আয়াতঃ ৬৮-৬৯
অর্থাৎ মধু আমাদের জন্য আল্লাহর দেওয়া এক অপূর্ব বড় নেয়ামত ।
মধু তৈরির প্রক্রিয়া
তিন ধরনের মৌমাছি রয়েছে। রানি মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি ও শ্রমিক মৌমাছি। সাধারণত শ্রমিক মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল হতে মধু সংগ্রহ করে তাদের একটি পাকস্থলীতে জমা রাখে। এরপরে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মধু নিঃসৃত হয়। মূলত এভাবেই তৈরি হয় মধু।
একটি মৌচাকে একটি রানী মৌমাছি থাকে। এবং প্রতিনিয়ত প্রজনন প্রক্রিয়ায় বংশ বৃদ্ধি করে। রানী মৌমাছি দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অন্যদিকে পুরুষ মৌমাছি কোনো কাজ করে না। তারা অলস প্রকৃতির হয়ে থাকে। এবং ২-৩ মাস পর্যন্ত তাদের গড় আয়ু।
মধুর প্রকারভেদ
নিচে মধু কত প্রকার ও কি কি তা আলোচনা করা হলো।
সরিষা ফুলের মধু
গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের মাঠ যখন সরিষার হলুদ ফুল দিয়ে ভোরে উঠে। তখন সরিষার ক্ষেতে মৌবাক্স স্থাপন করে চাষ করা হয় সরিষা ফুলের মধু। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রায় সারা বছর জমে থাকে, এবং হালকা রঙের হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়।
লিচু ফুলের মধু
লিচুর বাগানে যখন লিচুর ফুল ফোটে তখন মৌয়ালরা মৌবাক্স স্থাপন করে চাষ করে এই লিচু ফুলের মধু। এই লিচু ফুলের মধুর ঘ্রাণ লিচুর মতো হয়ে থাকে। এর ঘনত্ব পাতলা ও ঘন উভয় হতে পারে। স্থান , সময় ভেদে এই মধু অ্যাম্বার রঙের হয় ।
সুন্দরবনের মধু
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ হলো সুন্দরবন। এই সুন্দরবনে রয়েছে খলিশা, কেওড়া , গড়াই আরও বিভিন্ন নাম না জানা গাছ। মৌমাছি এ সকল গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক তৈরি করে। একে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধুও বলা হয়। এবং সকল খাঁটি মধুই ভালো। এরমধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মধু হলো সুন্দরবনের মধু।
কালোজিরা ফুলের মধু
পবিত্র আল কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ হল
কালোজিরা। কালোজিরা ফুল ফুটলে মৌয়ালরা চাষের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে থাকে। এই মধুর রং গাঢ় হয়ে থাকে। এবং ঘ্রাণ খেজুরের গুড়ের মতো।
প্রাকৃতিক মিশ্র ফুলের মধু
গাছের ডালে বা বাড়ির দেওয়ালে আমরা মৌচাক দেখতে পাই। আর এ সকল মৌচাকে বিভিন্ন ফুলের নেক্টার থেকে মৌমাছিরা সংগ্রহ করে রাখে। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট ফুলের নেক্টার থেকে মধু সংগ্রহ করে না বিধায় একে মিশ্র ফুলের মধু বলা হয়।
মধু জমে কেনো
মধুতে বিদ্যমান প্রায় ৪৮ টি উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দুইটি উপাদান হলো গ্লুকোজ ও ফ্রুটকোজ। এই গ্লুকোজ উপাদান যদি ফ্রুটকোজ উপাদানের চেয়ে বেশি হয়। তাহলে মধু জমে যায়। এই প্রক্রিয়াকে স্ফটিকায়ন বলা হয়। সরিষা ও লিচু ফুলের মধু এর মধ্যে অন্যতম।
চাকের মধু ও চাষের মধুর মধ্যে পার্থক্য
নিচে চাকের মধু ও চাষের মধুর পার্থক্য দেওয়া হলো।
চাকের মধু
মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল হতে মধু সংগ্রহ করে গাছের ডালে বা বাড়ির দেওয়ালে যে মৌচাক তৈরি করে তাকেই চাকের মধু বলা হয়। যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে না তাই একে মিশ্র ফুলের মধুও বলা যায়।
চাষের মধু
যে সকল ফুলের ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে মধু চাষ করা হলে তাকে চাষের মধু বলা হয়। যেমন কালো জিরা ফুলের মধু সংরক্ষণের জন্য কালো জিরার ক্ষেতে মৌয়ালরা বাক্স রেখে দেয়। তারপরে বাক্স থেকে মধু সংরক্ষণ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরিষা ফুলের মধু , লিচু ফুলের মধু চাষ করা হয়।
মধুর উপকারিতা
- মধুতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে শীতের ঠান্ডা , কাশি, গলা ব্যথার সমস্যা সমাধানে মধু দারুণ কার্যকরী।
- এত প্রচুর শর্করা ও গ্লুকোজ থাকার কারণে আমাদের শরীরের কান্তি দূর করে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে ।
- হজমে সহায়তা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ভূমিকা পালন করে ।
- ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী ও মজবুত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ।
- রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে ।
- অরুচি, বুক জ্বালাপোড়া, পেট ব্যথা এগুলো দূর করে ।
- নিয়মিত মধু খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরের ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল মাত্রা কমিয়ে উপকারী এইচডিএল কোলেস্টেরল মাত্রা বাড়ায়।
- মধু আমাদের শরীরের উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে ।
মধুর পুষ্টিগুণ
১ টেবিল চামচ মধুতে ৬৪ কিলো – ক্যালোরি রয়েছে। মধুর ৮০-৮৫% হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট (গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, মাল্টোজ ও সুক্রোজ) ১৫-১৭% হচ্ছে পানি, ০.৩ % আমিষ। এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, এন্টি অক্সিডেন্ট, আয়োডিন, কপার, জিংক ইত্যাদি।
খাঁটি মধুর বৈশিষ্ট্য
- মধুতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কোনো ক্ষতিকর উপাদান নেই।
- মধু সংরক্ষণে কোনো প্রিজারভেটিভস ব্যবহৃত হয় না কারণ মধু নিজেই পুষ্টিগুনে ভরপুর ।
- মধুতে অন্য কোনো পদার্থ সংমিশ্রণের প্রয়োজন হয় না।
মধু খাওয়ার নিয়ম
মধু সরাসরি খাওয়া যায়। অথবা কুসুম গরম পানির সাথে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ও ১-২ চামচ মধু এড করে ভালো ভাবে মিক্স করে রাতে ঘুমানো আগে খেলে শরীরের সকল ধরনের টক্সিক পদার্থ দূর হয়ে যায় । এছাড়াও ওজন কমাতে সকালে খালি পেটে মধু খাওয়া যাবে। যেহেতু সাদা চিনিকে হোয়াইট পয়সন করা হয়। তাই এর পরিবর্তে বিভিন্ন ডের্জাট আইটেম , স্মুদি বা জুস তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে মধু ।
মধু নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা
নিচে মধু নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা বর্ণনা করা হলো।
আগুন জ্বালিয়ে মধু পরীক্ষা করা
একটি তুলাতে মধু নিয়ে তা যদি আগুনে দেওয়া হয় এবং যদি সেই তুলার মধ্যে আগুন জ্বলে তাহলে এটি খাঁটি মধু নয়। না জ্বললে খাঁটি মধু । এই সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ আগুনে যেকোনো কিছু দিলে তা অবশ্যই জ্বলে যাবে।
মধুতে পিঁপড়া
ধারণা করা হয় খাঁটি মধুতে উঠবে না । মধু যেহেতু মিষ্টি তাই খাঁটি ও ভেজাল মধুতে পিঁপড়া আসতেই পারে ।
খাঁটি মধু কখনো জমে না
মধুর স্ফটিকায়ন প্রক্রিয়ার কারণে শীতকালে ঠান্ডার ফলে খাঁটি মধু জমতে পারে । এর মধ্যে অন্যতম হলো সরিষার ফুলের মধু । যদি কখনোও দেখেন মধু জমে নাই তাহলে বুঝতে হবে মধুতে ভেজাল আছে।
মধু নষ্ট হবে কি
খাঁটি মধু কখনোই নষ্ট হয় না । কারণ মধুতে প্রচুর পরিমাণে সুগার ও চিনির পরিমাণ বেশি আর খুবই অল্প মাত্রায় পানির পরিমাণ থাকে । হাইগ্রোস্ফোকিপ এর কারণে মধু কখনো শুকিয়ে যায় না । এবং কোনও মাইক্রোব এটিকে প্রভাবিত করতে পারেনা ।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
মধু রুম টেম্পারেচারে কাচের বোয়ামের মধ্যে রাখতে হবে। এবং মধুতে কখনও ভেজা চামচ ব্যবহার করা যাবে না । ফলে মধু দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
র মধু ও প্রসেসিং মধুর মধ্যে পার্থক্য
মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে । সেই মধুর চাক কেটে বা চাষের মাধ্যমে যে মধু পাওয়া যায় তাকে কাচা মধু বা র মধু বলে। অন্যদিকে বাজারের বিভিন্ন মধুকে তাপ দিয়ে প্রসেসিং করে বিক্রি করা হয়। ফলে মধুর গুণগান নষ্ট হয়ে যায়।
যাদের মধু খাওয়া নিষেধ
ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রে মধু বিপজ্জনক কারণ এটি রক্তে সরাসরি শোষিত হয় বলে সহজেই দেহের রক্ত শর্করা উচ্চস্তরে নিয়ে যায়। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগিদের জন্য মধু খাওয়া ভালো নয়। এছাড়াও বিভিন্ন বয়সের যে কেউ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমাদের সকলের উচিত পরিমাপ মতো সেবন করা।
উপরিউক্ত আলোচনায় মধু কি, প্রকারভেদ ও মধু নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।