You are currently viewing মতিচুর লাড্ডু কেন বিখ্যাত? এই লাড্ডুর ইতিহাস ও রেসিপি

মতিচুর লাড্ডু কেন বিখ্যাত? এই লাড্ডুর ইতিহাস ও রেসিপি

বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিশেষ করে ইদ, বিয়ে, পূজা, জন্মদিন ইত্যাদিতে মতিচুরের লাড্ডু অনেক জনপ্রিয় মিষ্টান্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান কারণ ঐতিহাসিক এই মিষ্টান্ন স্বাদে এবং গুনে অন্যান্য অনেক মিষ্টি খাবার থেকে ভালো। 

তাছাড়া প্রায় ২ হাজার বছর থেকে এই লাড্ডু তার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে এখন টিকে আছে। আমাদের আজকের লেখায় মতিচুর লাড্ডু কেন বিখ্যাত, এর ইতিহাস ও রেসিপি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

মতিচুর লাড্ডু কেন বিখ্যাত?

সব ধরনের খাবারের মধ্যে যখন একটি নির্দিষ্ট খাবার জনপ্রিয়তা লাভ করে তখন তার মধ্যে অবশ্যই কোন নিরপেক্ষ গুন থাকে। সেই দিক বিবেচনা করলে মতিচুর লাড্ডু একদম সঠিক পন্থায় তার জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সেই মৌর্য বংশের আমলে আবিষ্কৃত হওয়া মতিচুর লাড্ডু প্রথম দিকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সাধারণত রোগীদের বিভিন্ন রকমের রোগের চিকিৎসায় এই লাড্ডু দেওয়া হতো।

সেই সময় রোগ ভালো করার গুণের কারণে তা জন সমাজে ধীরে ধীরে আস্থার জায়গা করে নেয়। অর্থাৎ যখন এই লাড্ডু খেয়ে মানুষের রোগ মুক্তি হওয়া শুরু হয় তখন তা উপাসনার কাজে ব্যবহার শুরু হয়। এতে এই লাড্ডুর উপর মানুষ ভরসা শুরু করে এবং একে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। এমনকি যুদ্ধে যাওয়ার সময় যোদ্ধারা সাথে করে লাড্ডু নিয়ে যাওয়া শুরু করে। 

যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে লাড্ডুতে গুড়ের বদলে চিনি মেশানো শুরু হয়। এতে জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক সময় সাধারণ মতিচুর লাড্ডু থেকে তা ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ থেকে উচ্চবিত্ত তথা সেলিব্রিটিরা এই লাড্ডু খাওয়া থেকে শুরু করে বিপণনের সাথে জড়িত। 

বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি দেশে মতিচুর লাড্ডুকে সবাই এক নামে চেনে। এমন কি ভারতে বিয়ে বোঝাতে দিল্লিকা লাড্ডু হিসেবে মতিচুর লাড্ডুকে বোঝায়। প্রায় সকল ধরনের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বগণ তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, বিয়ে, জন্মদিন অথবা সাকসেস পার্টিতে মিষ্টির আইটেম হিসেবে মতিচুর লাড্ডু অন্তর্ভুক্ত করেন। 

বর্তমানে বেসনের লাড্ডু তৈরি করার পাশাপাশি অনেক স্থানে তিলের ও নারিকেলের লাড্ডু তৈরি করা হয়। প্রতিটি লাড্ডুর আলাদা আলাদা স্বাদ এবং বৈশিষ্ট্য থাকলেও মতিচুর লাড্ডু একটু আলাদা। মূলত এই লাড্ডুতে অনেক কম পরিমাণে চিনি ব্যবহার করা হয়। দেখতে শক্ত মনে হলেও এটি মুখে দেওয়ার সাথে সাথে গলে যায়। আপনি হাত দিয়ে হালকা চাপ দিলে তা সাথে সাথে ভেঙে যায় এবং ছড়িয়ে যায়। 

দেশি ঘি, বেসন ও দুধ দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে এতে প্রায় ৩৬২ এর মত ক্যালোরি থাকে। অন্যদিকে প্রতিটি লাড্ডুতে আনুমানিক ৪১% ফ্যাট, ২২% কোলেস্টেরল, ১০% কার্বোহাইড্রেট ও ৭% প্রোটিন থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি লাড্ডু দুধের থেকে দ্বিগুণ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে মতিচুর লাড্ডুকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

মতিচুর লাড্ডুর ইতিহাস

মতিচুর লাড্ডুর ইতিহাস

লাড্ডু ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। ধারণা করা হয়ে থাকে মতিচুর লাড্ডু সর্বপ্রথম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে তৎকালীন বিহারে উৎপত্তি লাভ করে। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে মতিচুর লাড্ডুর উৎপত্তি ও প্রচলন শুরু হয়। 

ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে মূলত ঔষধ হিসেবে লাড্ডু তৈরি করা হয়। অর্থাৎ তৎকালীন সময় কোন প্রকারের রাঁধুনি দ্বারা এই সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরি হয় নি। বরং সুশ্রুত নামক একজন ভারতীয় চিকিৎসক রোগ তাড়ানোর জন্য গুড়, মধু, চিনাবাদাম, তিল এক সাথে পিষে এক বিশেষ ধরনের লাড্ডু তৈরি করে যা পরবর্তীতে চোল রাজবংশের সৈন্যরা সৌভাগ্য মনে করে সাথে করে যুদ্ধে নিয়ে জেত। 

সাধারণত লাড্ডু থেকে মতিচূর লাড্ডু (Motichoor Laddoo) হওয়ার পেছনে সব থেকে বড় কারণ এর অনন্য স্বাদ। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ মতে লাড্ডু শব্দটি সংস্কৃত শব্দ “লাড্ডুকা” বা “লাত্তিকা” থেকে এসেছে। যার প্রচলিত অর্থ করলে দাঁড়ায় ছোট বল বা বলাকৃতি। অন্যদিকে হিন্দি মতি থেকে এসেছে মুক্তা এবং চূর থেকে এসেছে চূর্ণ-বিচূর্ণ অথবা ভাঙ্গা। অর্থাৎ মতিচুর লাড্ডু শব্দের প্রচলিত অর্থাৎ দাঁড়ায় মুক্তার ভাঙ্গা গুঁড়া। 

অন্য একটি ঐতিহাসিক জনশ্রুতি হিসেবে তৎকালীন মল্ল রাজা এক মিষ্টি ব্যবসায়ীকে গোবিন্দের জন্য প্রসাদ তৈরি করার নির্দেশ দেন। দিগ্‌বিদিক না পেয়ে সেই মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রসাদ তৈরি করার কাজে নেমে পরেন। তো সঠিক ভাবে সুস্বাদু ও মিষ্টি প্রসাদ তৈরি করার জন্য তিনি স্থানীয় পিয়াল গাছের বীজ সংগ্রহ করেন। সেগুলো ভালো করে শুকিয়ে তা ভেজে নেন এবং তা থেকে বেসন তৈরি করেন। 

সেই বেসন গুলোকে ছোট ছোট মুক্তার মত করে তৈরি করে তা ভেজে সেগুলো একত্র করে তা হাতে চেপে লাড্ডু তৈরি করেন। লাড্ডুর বাইরের অংশের ছোট ছোট বেসনের গুটি গুলো দেখতে মতির মত হওয়ায় এর নাম পরবর্তীতে মতিচুর লাড্ডু হিসেবে প্রচলিত হয়। 

ইতিহাস যাই থাকুক না কেন, মতিচুর লাড্ডু ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সেই শুরু থেকেই মিষ্টান্ন ও পবিত্র খাদ্য হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় মতিচুর লাড্ডু সফলতার সব থেকে উঁচু স্থানে প্রবেশ করেছে। 

মতিচুর লাড্ডুর রেসিপি

মতিচুরের লাড্ডু অনেক ঐতিহাসিক খাবার যা সব জায়গায় পাওয়া যায় না। তাছাড়া দামের দিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় এই লাড্ডু অনেকের ক্রয়সীমার বাইরে থাকে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমরা সহজেই ঘরে মতিচুরের লাড্ডু তৈরি করতে পারি। ঘরে মতিচুর লাড্ডু (Motichoor Laddu) তৈরি করার উপকরণ ও প্রণালি নিচে রেসিপি আকারে বর্ণনা করা হলো। 

উপকরণঃ 

  • বেসন 
  • চিনি
  • পানি
  • বেকিং পাউডার 
  • খাবার রং (কমলা)
  • দুধ
  • ঘি 
  • কাজুবাদাম
  • পেস্তাবাদাম 

মতিচূর লাড্ডু প্রস্তুত প্রনালী

প্রতিটি জেলা ও অঞ্চল ভিত্তিক বিখ্যাত কিছু খাবার, জিনিস কিংবা জায়গা থাকে। যা ঐ জেলার বিখ্যাত বা ফেমাস। যেমন বগুড়া দই মিষ্টির জন্য, গাইবান্ধা রসমঞ্জুরি, পাবনার ঘি, প্যারা সন্দেস, নওগা জেলার প্যারা সন্দেস, পোড়াবাড়ির চমচম, খুলনার চুইঝাল, মুন্সিগঞ্জ ভাগ্যকুলের মিষ্টি ইত্যাদি। মুন্সিগঞ্জ ভাগ্যকুল মিষ্টি ও এর বিপরীত নয়।

এর তৈরির প্রসেস কিছু টা সাধারন মিষ্টির মতো মনে হলেও অসাধারন টেষ্ট রয়েছে। আর তৈরি দক্ষতার কৌশল এর স্বাদকে করেছে বিখ্যাত ও সবার কাছেই প্রিয়। সাধারণত মতিচুর লাড্ডু তৈরি করার জন্য দুই ধাপে কাজ করতে হয়। নিচে ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো। 

বুন্দিয়া তৈরি 

আমরা জানি মতিচুর লাড্ডু অনেকগুলো ছোট ছোট বুন্দিয়ার সমন্বয়ে তৈরি হয়। এই জন্য সবার প্রথমে আমাদের বুন্দিয়া তৈরি করে নিতে হবে। তো বুন্দি অথবা বুন্দিয়া তৈরি করার জন্য সবার প্রথমে আমাদের বেসন ও বেকিং পাউডার একত্রে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর এই মিশ্রণে প্রয়োজন মত ঘি এবং পানি মিশিয়ে তা অতি দ্রুত নাড়তে হবে। 

দ্রুত নাড়ার কারণে উক্ত মিশ্রণ অনেক ঘন হবে। এরপর একটি বড় কড়াইয়ে ঘি দিয়ে তা গরম করে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে আপনি ঘি এর পরিবর্তে তেল ব্যবহার করতে পারবেন। তবে ঘি দিয়ে তৈরি করা লাড্ডু বেশি সুস্বাদু হয়। যাইহোক, ঘি যখন গরম হবে তখন একটি ঝাঁজরি চামচ উত্তপ্ত ঘি এর উপরে রেখে তাতে হালকা করে বেসন মিশ্রণ ঢালতে হবে। 

এতে বেসনের মিশ্রণ সেই চামচ দিয়ে অনেক সুন্দর ও ছোট গোলাকার হিসেবে ঘি এর তেলে পরবে এবং ভাঁজা হয়ে যাবে। এভাবে সুন্দর করে ভেজে বুন্দিয়া গুলো আলাদা করে রাখতে হবে। এরপর শুরু হবে লাড্ডু তৈরি করার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া। 

লাড্ডু তৈরি 

যখন বুন্দিয়া তৈরি করা শেষ হবে তখন আলাদা একটি পাত্রে চিনি দিয়ে তাতে প্রয়োজন মত পানি দিয়ে তা চুলায় দিতে হবে। একটু পর সেই চিনির মিশ্রণে দুধ ও ফুড কালার দিয়ে মাঝারি আঁচে জ্বাল দিতে হবে। কিছু সময় জ্বাল করার পর দেখা যাবে চিনি পুরোপুরি মাত্রায় গলা শুরু করে দিবে। যখন সবগুলো চিনি গলে যাবে এবং মিশ্রণটি আঠালো হয়ে যাবে তখন তাতে কাজুবাদাম ও পেস্তাবাদাম দিয়ে দিতে হবে।

প্রায় শেষের দিকে ভাঁজা বুন্দিয়া গুলো চিনির আঠালো সিরায় দিয়ে অল্প সময় ভেজে নিতে হবে। যখন চিনির সিরা ও বুন্দিয়া মিশে যাবে তখন সেগুলো অন্য একটি পাত্রে নামিয়ে নিতে হবে। উক্ত বুন্দিয়া মিশ্রণ যখন হাতে সহ্য করার মত গরম অবস্থায় পৌঁছাবে তখন তা হাতে নিয়ে প্রয়োজন মত গোলাকার লাড্ডু তৈরি করতে হবে। 

পরিপূর্ণ ভাবে উপরে বর্ণিত উপায় অনুসরণ করলে বিখ্যাত লাড্ডু তৈরি করা সম্ভব। এই রেসিপিতে বুন্দিয়া তৈরি করে অথবা বাজার থেকে কেনা বুন্দিয়া ব্যবহার করা যাবে। তবে স্বাদের দিকে চিন্তা করলে এই লেখায় বর্ণিত রেসিপি অনেক সাহায্য করবে। 

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.