স্বাস্থ্য উপাদানের কথা চিন্তা করলে বাদাম,অন্য সকল ড্রাই ফুডের চেয়ে উন্নত এবং অধিক পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ। কারণ বাদাম জাতীয় খাবারে একাধারে ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট এবং শর্করা থেকে শুরু করে অন্যান্য আরো অনেক উপকারী পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন অনেক বাদামের মধ্যে আখরোট অন্যতম যা ওয়ালনাট হিসেবেও পরিচিত। নিচে ওয়ালনাট কি, এটি খাওয়ার নিয়ম এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
আখরোট কি?
আখরোট একটি পুষ্টিকর বাদাম জাতীয় ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Juglans Regia যাকে Jovis glans বা জিউসের বাদাম নামে ডাকা হয়। এই কারণে আখরোটকে দৈব খাদ্যও বলা হয় এবং এটি একটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য।বিশেষ করে ড্রাই ফুড হিসেবে Wallnut বা আখরোটের কোনো তুলনাই হয় না। এতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, ওমেগা-৩, ১৫% প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, সুগার, ফাইবার এবং ক্যালোরি, ৬৫% ফ্যাট। এগুলো বাদেও আখরোটে রয়েছে ভিটামিন, ফাইবার, অ্যামিনো অ্যাসিড, খনিজ যেমন- আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, কপার এবং ম্যাংগানিজ। এ সকল পুষ্টি উপাদান বিবেচনা করে এই বাদাম কে পাওয়ার হাউজ বলা হয়।
আখরোট কিভাবে খায়?
আখরোট খাওয়ার বিভিন্ন উপায় রয়েছে নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
ড্রাই ফুড হিসেবে
বর্তমান সময়ে উচ্চ পুষ্টির খাবার হিসেবে ড্রাই ফুডের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। ড্রাই ফুড তৈরি করার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা খাবারের সাথে অনেক রকমের বাদাম ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে পেস্তা বাদাম, কাজু বাদাম এবং কাঠ বাদামের সাথে আখরোট মেশানো হয়। এতে পুরো মিশ্রণের মধ্যে পুষ্টি উপাদান সঠিকভাবে বণ্টন হয়। এই কারণে ড্রাই ফুড হিসেবে শুরু থেকেই ওয়ালনাট বা আখরোট ব্যবহার হয়ে আসছে।
মধুর বা দুধের সাথে
মধুর সাথে অথবা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়ার জন্য আখরোট অনেক জনপ্রিয়। প্রতিদিন সকালে এবং বিকেলে মধুর অথবা দুধের সাথে দুই দানা আখরোট মিশিয়ে খেলে তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য উপকারিতা নিশ্চিত করে।
মধু বা দুধের সাথে এই বাদাম খেলে উক্ত খাবার গুলো থেকে যে যে উপকারী উপাদান পাওয়া যায় তা মাল্টিপ্লাই হয়ে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ মধুর সাথে খেলে মধুর গুণাগুন ও ওয়ালনাটের পুষ্টিগুণ এক সাথে হয়ে অন্যান্য খাবারের থেকে বেশি পুষ্টি সরবরাহ করে। অন্য দিকে ঠিক একই ভাবে দুধের সাথে খেলেও পুষ্টি বৃদ্ধি পায়।
পানিতে ভিজিয়ে
ধরুন আপনার কাছে মধু অথবা দুধ কিছুই নেই তখন কি আখরোট খাওয়া যাবে না? অবশ্যই যাবে, তখন আপনাকে ওয়ালনাট পানিতে ভিজিয়ে খেতে হবে। আপনি এমনি শুকনা হিসেবেও খেতে পারবেন তবে এতে পেটে বদহজম সহ অ্যাসিডিটির সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে পানিতে ভিজিয়ে খেলে আখরোটের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পায়। এই কারণে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পানিতে ভেজানো আখরোট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
গুঁড়ো করে
শুকনো ওয়ালনাট গুঁড়ো করে তা কফির সাথে অথবা কেকের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এতে উক্ত খাবারের যেমন স্বাদ বৃদ্ধি পায় তেমনি সর্বোপরি উপকারী পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ আখরোট গুঁড়ো করে তা দিয়ে নানান পদের খাবার তৈরি করে খাচ্ছে। এতে ওয়ালনাটের পুষ্টি উপাদান নষ্ট হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না।
আখরোট খাওয়ার উপকারিতা
আখরোট খাওয়ার নানামুখী উপকারিতা রয়েছে। নিচে বিস্তারিতভাবে উপকারিতাগুলো আলোচনা করা হয়েছে।
ডায়াবিটিসের ঝুঁকি কমায়
আখরোট রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে রক্তে থাকা ক্ষতিকর শর্করা প্রতিরোধ করে এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে। যেহেতু রক্তে থাকা শর্করা ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ সেহেতু আখরোট পরোক্ষভাবে এর ঝুঁকি কমায়। অর্থাৎ নিয়মিত ওয়ালনাট খেলে তা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি তা প্রতিরোধ করে।
ওজন কমায়
আখরোটে থাকা অতিরিক্ত ফ্যাট থাকার কারণে অনেকেই মনে করে এটি খেলে ওজন বৃদ্ধি পাবে। তবে এতে থাকা ওমেগা-৩, প্রোটিন ও ফাইবার দেহের পুষ্টি উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে ওজন ঠিক রাখে। তবে কখনোই ওয়ালনাট বেশি খাওয়া যাবে না কারণ এতে দেহে অতিরিক্ত ফ্যাট জমা হবে যা স্থূলতা বৃদ্ধি করে।
হৃদরোগ প্রতিরোধ করে
হৃদ রোগের জন্য সব থেকে বেশি দায়ী হল ক্ষতিকর কোলেস্টরেল, ফ্যাট এবং রক্তে থাকা শর্করা। এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য আখরোট অনেক ভালো কাজ করে। কারণ আখরোটে আছে ওমেগা-৩, ভিটামিন, ফাইবার, এন্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদি উপাদান। এগুলো দেহের সকল পুষ্টিগুণ স্বাভাবিক রাখে এবং রক্ত চলাচল বাধামুক্ত রাখে। এতে হৃৎপিণ্ড সচল থাকে এবং এর পারিপার্শ্বিক পেশীগুলো কর্মক্ষম থাকে। এই কারণে সম্ভাব্য হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ হয়।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
দেহের কর্মক্ষমতা স্বাভাবিক রাখার জন্য কোলেস্টেরেলের প্রয়োজন হয়। তবে ক্ষতিকারক এলডিএল কোলেস্টরেল উপকারের থেকে ক্ষতি বেশি করে। বিশেষ করে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করার জন্য এই এলডিএল কোলেস্টরেল দায়ী।নিয়মিত আখরোট বা ওয়ালনাট খেলে তা রক্তে থাকা এই ক্ষতিকারক উপাদান দূর করে এবং শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমার সাথে সাথে অন্যান্য সমস্যা নির্মূল হয়।
শিশুদের বিকাশে সাহায্য করে
শিশুর শারীরিক ও মানুষিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য যে যে স্বাস্থ্য উপাদান প্রয়োজন তার প্রায় সব গুলই ওয়ালনাটে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ওমেগা-৩, ভিটামিন, খনিজ, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি উপাদান যা শিশুর শরীর সুগঠিত হতে সাহায্য করে। এতে শিশুর অপুষ্টি সমস্যার সমাধান হয়। এ সকল দিক বিবেচনা করে দেখা যায় প্রকৃতি থেকে পাওয়া আখরোট শিশুর স্বাস্থ্য বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
মস্তিষ্ক ভালো রাখে
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডকে একটি সর্বজনীন উপকারী পুষ্টি উপাদান বলা হয়। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া যায় এমন খাবারের মধ্যে ওয়ালনাট অন্যতম। অন্যদিকে ওমেগা থ্রি এন্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করার পাশাপাশি মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। অর্থাৎ নিয়মিত আখরোট খেলে তা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
মধুতে মাখানো আখরোট – স্বাদ ও পুষ্টির সেরা মিশ্রণ
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
আখরোটের পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, পলিফেনলস এবং ইউরোলিথিন থাকে যাদের ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান বলে। এই কারণে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয় নিয়মিত আখরোট খেতে কারণ এতে থাকা পুষ্টি উপাদান সব ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে স্তন, প্রটেস্ট এবং কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয় উপাদান ওয়ালনাটে বিদ্যমান।
হাড় শক্ত করে
ওয়ালনাটে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে। হাড় শক্ত ও মজবুত করার জন্য ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন পরে। নিয়মিত আখরোট খেলে তা শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে যা অস্থিমজ্জা শক্তিশালী করার পাশাপাশি হাড়ের গঠন সুগঠিত করে।
শুক্রাণুর মান বৃদ্ধি করে
বীর্যে স্বাস্থ্যবান শুক্রাণু না থাকলে তা থেকে সন্তান উৎপাদন হয় না। প্রাকৃতিক উপায়ে শুক্রাণুর মান বৃদ্ধি করার যে যে খাবার আছে আখরোট তাদের মধ্যে অন্যতম। নিয়মিত মধুর সাথে আখরোট মিশিয়ে খেলে তা যৌন স্বাস্থ্য উন্নত করার সাথে সাথে শুক্রাণুর মান বৃদ্ধি করে।
চুলের উপকার করে
চুলের জন্য উপকারী উপাদান যেমন পটাশিয়াম, ওমেগা থ্রি, ওমেগা সিক্স ও ওমেগা নাইন ইত্যাদি আখরোটে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। এই কারণে নিয়মিত ওয়ালনাট খেলে তা চুল শক্ত করে, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে, চুলের গোঁড়া মজবুত করে। এতে চুল হয় ঘন, কালো, লম্বা এবং স্বাস্থ্য উজ্জ্বল।
ভালো ঘুমের জণ্য সহায়ক
ভালো ঘুমের জণ্য প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন এই আখরোট। আখরোটে থাকা মেলাটোনিল, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, আমাদের রক্ত চাপ কমাতে এবং স্ট্রেস উপশম করতে সাহায্য করে । যা ভালো ঘুমের জণ্য সহায়ক।
গর্ভাবস্থায় উপকারী
আমরা জানি আখরোটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি, ফোলেট, রাইবোফ্লাভিন, থিয়ামিন এবং ফলিক অ্যাসিড থাকে যা গর্ভবতী মা এবং অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ আখরোট খেলে তা গর্ভাবস্থায় উপকারী হিসেবে কাজ করে।
ডার্ক সার্কল দূর করে
আমরা জানি ডার্ক সার্কেল তৈরি হয় অনিদ্রা, দুশ্চিন্তার কারণে। নিয়মিত ওয়ালনাট খেলে তা মানুষিক অবসাদ দূর করে এতে স্ট্রেস দূর হয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত ঘুম হয়। অন্যদিকে এতে থাকা ফাইবার, আলফা লাইনলেনিক অ্যাসিড এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট চোখের নিচে ফোলাভাব দূর করে এবং চেহারার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
সর্তকতা
সুস্থ্য থাকার জন্য আমাদের যেকোণো খাবার ই পরিমিত পরিমানে খেতে হবে। প্রয়োজনের অধিক খাবার খেলে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ঠিক তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক আখরোট খেলে হতে পারে বিপত্তি! যেমন – লিভারে সমস্যা হওয়া অ্যালার্জি সমস্যা হওয়া আবার অনেক সময় হজমেও সমস্যা দেখা যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন পূর্ন বয়ষ্ক মানুষের নিয়মিত ৫ টি আখরোট খাওয়ায় যথেষ্ট।
বাদাম আমরা সকলেই পছন্দ করি। বাদাম ব্যবহার করে অনেক মুখরোচক খাবার তৈরি করা হয়। আমরা নিয়মিত এই খাবার গ্রহণ করলেও এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখি না। আশা করি এই লেখা পরে আপনি আখরোট বা ওয়ালনাট সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করেছেন।