স্কুলে পড়াকালীন একবার ঈদের ছুটিতে মামা বাড়ি গিয়েছিলাম হুট করেই। তখন রোজা চলছিল একদম এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। চারিদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ। ইফতারে শরবতের পাশাপাশি ঠান্ডা কি খাওয়া যায় এটা নিয়ে ভাবছিলাম সবাই। তবে ছোটবেলার কবিতায় পড়া “ মামা দিলো দুধভাত মজা করে খাই, মামি এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই” এমন পরিস্থিতিতে কিন্তু আমার পড়তে হয় নি। বরং ছোট মামি আমাদের জন্য রান্না করেছিলো মজার লাচ্চা সেমাই।
তাও আবার যেমন তেমন সেমাই না। বগুড়ার বিখ্যাত লাচ্চা সেমাই। যদিও আমি খুব বেশি মিষ্টি প্রেমি না তবে সেদিনের সেই ঠান্ডা ঠান্ডা লাচ্চা সেমাই টি আমরা ভীষণ রকমের ভালো লেগেছিলো। পায়েস বা ক্ষির যেমন ফ্রিজে রাখলে এর টেস্ট বেড়ে যায় সেমাই ও ঠিক তেমন। সেই থেকে অন্যান্য মিষ্টি খাবার না খেলেও মাসে অন্তত একবার হলেও এই লাচ্চা সেমাই আমার খেতেই হয়।
দুধ এবং সেমাই দিয়ে তৈরি করা এই মজাদার ডেজার্ট আইটেম নিশ্চয় আমার মতো আপনাদের ও অনেক পছন্দের। সাধারণত রমজান এবং ঈদের মৌসুমেই এই সেমাইয়ের কদর বেশী। তবে এই লাচ্চা সেমাই ইদ ও রমজান ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে রান্না করা হলেও এই সেমাইয়ের বিশেষ প্রস্তুত প্রণালি ও ইতিহাস সম্পর্কে কি আমরা জানি? চলুন তবে আজ জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এবং কোথায় থেকে এলো এই লাচ্চা সেমাই!!!-
সেমাই কী?
সেমাই মূলত একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার। ময়দার ফালিকে চিকন চিকন সুতোতে পরিণত করে বানানো হয় এই সেমাই। যা পরবর্তীতে দুধ এবং চিনি মিশিয়ে রান্না করলেই মজাদার মিষ্টি খাবারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় এই সেমাই। বিশেষ করে রমজান এবং ঈদে এই সেমাইয়ের কদর বেড়ে যায় বহুগুণে। সেমাই মূলত দুই প্রকার।
- খিল সেমাই।
- লাচ্চা সেমাই।
স্বাদ বিবেচনায় বাঙালিদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে লাচ্চা সেমাই। লাচ্চা সেমাইয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি একদম চিকন একটি সেমাই। সেই সাথে খুব সহজে এবং অল্প সময়েই এটি রান্না করা যায়।
লাচ্ছা সেমাইয়ের উৎপত্তি
রমজান এবং ইদ উপলক্ষ্যে লাচ্চা সেমাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও এর উৎপত্তি এবং নাম নিয়ে নানান মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে এটি একটি পার্সিয়ান খাবার যেটি মোঘলদের হাতে ধরে সূচনা হয়েছে। পার্সিয়ান এই খাবার টি রেস্তেহ নামে পরিচিত। তবে এই রেস্তেহ এর সাথে সেমাইয়ের আকৃতি গত সাদৃশ্য থাকলেও স্বাদের রয়েছে বিশাল পার্থক্য। অন্যদিক আরবি শব্দ ‘লম্বুতদার’ রাজধানী ঢাকার আদি নাগরিকদের মুখে ‘লাচ্ছাদার’ উচ্চারিত হতো। ‘লম্বুতদার এবং লাচ্ছাদার দুইটা শব্দের অর্থ হলো ‘সুস্বাদু’। তাই ধারণা করা হয় ঢাকায় আসা অবাঙালি অথবা আদি ঢাকাইয়া দের হাত ধরেই এর লাচ্চা সেমাইয়ের উৎপত্তি এবং লাচ্ছাদার শব্দ থেকেই মূলত লাচ্চা সেমাই নামকরণ হয়েছে।
লাচ্চা সেমাই কত প্রকার?
লাচ্চা সেমাই তৈরি প্রসেস একই হলেও শুধু মাত্র এই সেমাই ভাজার উপরে নির্ভর করে লাচ্চা সেমাই কে ৩ টি ক্যাটাগরি তে ভাগ করা হয়েছে।
- ঘি ভাজা সেমাই।
- ডালডা ভাজা সেমাই।
- পাম অয়েল বা ভোজ্য তেলে ভাজা সেমাই।
যেভাবে তৈরি করা হয় এই মজার লাচ্চা সেমাই!
সকল সেমাইয়ের মাঝে সেমাই তৈরির প্রসেস টা একটু বেশিই সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। পারফেক্ট লাচ্চা তৈরির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দক্ষ্য কারিগর। দক্ষ্য কারিগর ছাড়া কখনোই পারফেক্ট স্বাদের সেমাই তৈরি সম্ভব না। ময়দা থেকে কারিগরদের সুনিপুণ কারিশমায় তৈরি হয় এই লাচ্চা সেমাই। এটি তৈরি এর জন্য প্রথমে ময়দা এর সাথে পানি মিশিয়ে ময়দার খামির তৈরি করা হয়।
এই খামিরটি কিন্তু সাধারণ রুটি তৈরির খামিরের মতো না। সঠিক মাত্রার পানি এবং ময়দা মিশিয়ে এটিকে বেশ লম্বা সময় ধরে মাখিয়ে খামির তৈরি করে নিতে হয়। এরপর সেই খামিরকে ঘি মাখিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রেখে দেওয়া হয়। এতে করে খামির টি নরম থাকে বেশ খানিক টা সময়ের জন্য। খামির রেডি হওয়ার পর শুরু হয় কারিগরদের আসল কারিশমা।
ময়দার সেই খামিরকে সুনিপুণ হাতে সুকৌশলে হ্যাঁচকা টান দিতে হয় প্রায় ৯ বার। আর সুনিপুণ হাতে এই ৯ টানেই ময়দা গুলো চিকন চিকন সুতোর রূপ ধারণ করে। সেমাই যতো চিকন হয়, সেমাইয়ের স্বাদ ততো বৃদ্ধি পায়। এরপর এই চিকন সেমাই গুলো ঘি/ ডালডা তে ভেজে অতিরিক্ত তেল ঝড়িয়ে প্যাকেটজাত করা হয়।
রমজান ও ঈদে লাচ্চা সেমাইয়ের চাহিদা বেশি কেন?
ঈদের আনন্দের সাথে সেমাই যেন একে অপরের পরিপূরক। সেমাই ছাড়া ইদ কল্পনায় করা যায় না। হাদিসে উল্লিখিত আছে, ঈদের দিনে মিষ্টি খাবার খেয়ে নামাজ আদায় করা সুন্নত। আর ঠিক সে কারণেই হয়ত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইদের দিনের মিষ্টি আইটেম হিসেবে সেমাইকে বেছে নিয়েছে। এছাড়াও চটজলদি এবং খুব সহজেই তৈরি করা যায় এই সুস্বাদু এই লাচ্চা সেমাই। সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারিতে প্রয়োজন একটি ঠান্ডা ঠান্ডা মিষ্টি ডেজার্ট আইটেম। আর এই ডেজার্ট আইটেম হিসেবে সেমাইয়ের অপশন টা সবচেয়ে বেস্ট।
ঈদ স্পেশাল বাহারি পদের সেমাই বানানোর রেসিপি
বগুড়ার বিখ্যাত লাচ্চা সেমাই
লাচ্চা সেমাই সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের কদর বহুদিনের। প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বগুড়াতে এই লাচ্চা সেমাই কে ঘিরে প্রতি রমজানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরের বগুড়ার দই, মিষ্টি এবং কটকটি এর পাশাপাশি বগুড়ার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে এই চিকন লাচ্চা সেমাই। এমনকি বগুড়ার এই লাচ্চা সেমাইয়ের কদর এতো বেশি যে শুধু দেশেই না বরং বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে এই লাচ্চা সেমাই। বগুড়ার শেওলাগাতি, বেজোড়া, সাবগ্রাম, ঘাটপাড়া তে রয়েছে বহু পুরোনো সেমাই পল্লি।
লাচ্চা সেমাই এর দাম
লাচ্চা সেমাই মূলত দুই প্রকার। একটি হলো ঘিয়ে ভাজা লাচ্চা সেমাই এবং অন্যটি হলো ডালডা ভাজা লাচ্চা সেমাই। কোয়ালিটি হিসেবে এই সেমাই গুলো আলাদা আলাদা প্রাইজের হয়ে থাকে। সচরাচর ডালডা ভাজা লাচ্চা সেসময়ের চেয়ে ঘিয়ে ভাজা লাচ্চা সেমাইয়ের দাম টা তুলনামূলক বেশী।
অন্যদিকে কোম্পানি হিসেবেও সেমাইয়ের দামের পার্থক্য হয়ে থাকে। মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা সেমাইয়ে খুব বেশী স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ মেইনটেইন করা হয় না। তাই সেমাই কেনার আগে যাচাই বাছাই করেই প্রডাক্ট কেনা সবচেয়ে ভালো। বাজারে জনপ্রিয় কিছু সেমাই এর ব্যান্ড হলোঃ প্রাণ, বনফুল, কুলসুম,বসুন্ধরা ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ফেসবুক পেজে সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে বগুড়ার লাচ্চা সেমাই তৈরি করা হয়, যেমনঃ বিন্নিফুড।
কোয়ালিটি হিসেবে এসব সেমাইয়ে প্রাইজ শুরু হয় ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকা অবধি। অবশ্য এর চেয়ে কম দামেও লোকাল বাজারে লাচ্চা সেমাই পাওয়া যেতে পারে। তবে সেগুলো কোয়ালিটি অথবা টেস্ট কোনোদিক দিয়েই সেরা হবে না।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি ভেজাল লাচ্চা সেমাই হতে সাবধান!
নিজের ও প্রিয়জনের জন্য শখের সেমাই তো কিনছেন, তবে সেই সেমাই টি কতটুকু কোয়ালিটি সম্পূর্ণ এটা অবশ্যই যাচাই বাছাই করবেন। প্রায় প্রতিবার, ঈদকে কেন্দ্র করে সেমাই তৈরির কারখানাগুলোতে ব্যস্ততম সময় কাটে কারিগরদের। ক্রেতাদের বিপুর চাহিদার কারণে তখন অনেক ব্যবসায়ী অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ভেজাল সেমাই তৈরি করেন।
এসব সেসময়ে নিম্ন মানের ময়দা, তেল ও অনেক সময় কাপড়ের রং পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। তাই ভেজাল মিশ্রিত এসব সেমাই খেলে আপনি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন। প্রতি ঈদেই অবশ্যই ভোক্তা অধিদপ্তর এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সেমাইয়ের বাজার ও কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করা হয়। তবুও মাঝে মাঝে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়েও অনেক সময় এসব নিম্নমানের লাচ্চা সেমাইয়ে বাজার ভরপুর হয়ে ওঠে। তাই বাজার থেকে লাচ্চা সেমাই কেনার আগে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন।
খুব সহজেই লাচ্চা সেমাই রান্নার রেসিপি
লাচ্চা সেমাই রান্না করাটা কিন্তু বেশ সহজ। শুধু দুধ এবং সেমাইয়ের পরিমাণ টা সঠিক জানলেই আপনি পার্ফেক্ট সেমাই রান্না করতে পারবেন। এর জন্য আপনার প্রয়োজন-
- দুধ- ২ কেজি
- লাচ্চা সেমাই-২৫০ গ্রাম
- চিনি-স্বাদমতো
- সামান্য তেজপাতা, দারুচিনি ও এলাচ
প্রথমে একটি পাত্রে দুধ গরম করতে দিন। এরপর দুধের মাঝে চিনি এবং তেজপাতা, দারুচিনি এবং এলাচ যোগ করে নাড়তে থাকুন। দুধ ঘন হয়ে এলে এতে এড করে নিন লাচ্চা সেমাই। এবার ২/৩ মিনিট পর সেমাই গুলোকে একটি পাত্রে ঢেলে পরিবেশন করে নিতে পারেন মজাদার লাচ্চা সেমাই।